শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) দুই বাংলার বিখ্যাত কবি এবং শ্রেষ্ঠ কবি ।
বহুমাত্রিক কবি শামসুর রাহমানের কবিতা সামনে পড়লেই মনে পড়ে একজন বিশুদ্ধ কবিকে যার আনত লাজুক মুখ ,সাদা চুল , স্মিগ্ধ অবয়ব ,মোটা ফ্রেমের চশমায় মৃদুভাষী --অথচ কলম তীক্ষ্ণ ,সাহসী ,আধুনিক এবং একটা নতুন যুগের সৃষ্টি করেন তিনি একাই ।
প্রখ্যাত ফরাসি ভাবুক জ্যাক দেরিদা সাহিত্য সম্পর্কে বলেন , সাহিত্য হচ্ছে এমন একধরনের ‘প্রতিষ্ঠান’ যা একজন মানুষকে যেভাবে ইচ্ছে, যা ইচ্ছে, তাই বলবার অধিকার দেয় "। যেহেতু সাহিত্য আমাদের আবেগকে , ভেতরের ঘোরকে , মোহময়তাকে রূপ দেয়, ফলে এই অধিকার একজন ভোগ করতেই পারে ।
  কবির একটা দায়বদ্ধতা থাকে সমাজের প্রতি , দেশের প্রতি ।যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেন সৌন্দর্য সৃষ্টি করাই কবির একমাত্র কাজ । এক্ষেত্রে দায়িত্বের চাইতে বড় যে ব্যপার সেটা হলো শামসুর রাহমান এই বিষয়টিকে মনে রেখেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর কাব্যজগত, অভিষিক্ত হয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধান কবির মর্যাদায়। জীবদ্দশাতেই শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তী কবিপুরুষ ।
বহুবিস্তৃত বিষয়, ভাষিক বহুস্বর আর বহুমাত্রিকতায় গভীর তাঁর কাব্যজগত । একদিকে নিঃসঙ্গ মনোবাস্তবতা, অন্যদিকে যুথবদ্ধ জাতিগত সংগ্রাম আর আন্দোলনের অংহকারকে তিনি কবিতায় চমৎকারভাবে উপজীব্য করে তুলেছেন । -
সাহিত্যকে বলা হয় জীবনের দর্পণ ।  সাহিত্য যুগে যুগে কালের ও দর্পণ । মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে যেমন এসেছে সমকালীন জীবনের একটা জ্বলজ্বলে চেহারা তেমনি আধুনিক যুগের সকল কবি / লেখকবৃন্দের লেখায় সমাজ এসেছে , দেশ এসেছে , রাজনীতি এসেছে তেমনি সমকালীন প্রেক্ষাপট ও এসেছে ।
এভাবে যুগে যুগে সাহিত্যই সমাজকে তুলে ধরে - সে প্রেক্ষিতে কবি শামসুর রাহমানের লেখায় সমকালীনতা এসেছে এবং কবির ভুমিকা কখনো যোদ্ধার , কখনো প্রেমিকের , কখনোবা লাজুক চেহারার এক উদাস দার্শনিকের যিনি দূর থেকে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখেন , ভালোবাসেন  । অন্যায় অত্যাচারী স্বৈরাচার দখলদার বাহিনীর নৃশংশতা দেখেন , প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং তাঁর কলম হয়ে ওঠে ক্ষুরধার তরবারী ।
শামসুর রাহমান যে সময়ে কবিতা লিখেছেন, সেই সময়ের অভিঘাত, রূপ-রস-গন্ধ তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় ! কবি দূরগ্রহের অস্পষ্ট ছায়ার বাসিন্দা নন, তিনি-তো তাঁর সময়কাল ও সমাজেরই একজন বাসিন্দা । কবি তাঁর চেতনা ও সূক্ষ্ম বুদ্ধির মাধ্যমেই এক ধরনের বোধ সঞ্চারিত করেন - কবিতায়, কবিতার পাঠক সেই বোধে সিক্ত হন । শামসুর রাহমানের দৃষ্টিভঙ্গির যে মূলভুমি আধুনিক মানুষের মনন ও চেতনারই বহু¯বিস্তৃত এলাকা নিয়ে উচ্চকিত, সেখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা বিশেষ মূল্য নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। শামসুর রাহমানের দায়বদ্ধতা শুধু তাঁর কবিতাকে নয় বাংলা কবিতাকে দিয়েছে এক নতুন-মাত্রা। বাংলা কবিতার মূলধারাকে করেছে আরও সংহত, গতিশীল ও দিগন্ত-প্রসারী।
" হাতির শুঁড়"শামসুর রাহমানের  কবিতা যেখানে আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে্ন ,তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে যুদ্ধাস্র তিনি হয়ে ওঠেন সময়ের সাহসী সৈনিক ।
টেলেমেকাস ছিলো তার অন্য একটি কবিতা যেখানে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমান যখন পাকিস্তানের কারাগারে সে সময়ে লিখেন । সেটা ছিলো ১৯৬৬ সাল ।
ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে
দরজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।
এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার
বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ
আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে টঙ্কার?
ইথাকা নগরী যখন অবরুদ্ধ ,টেলেমেকাস স্বদেশের জন্য ব্যথিত, ক্ষুদ্ধ , ঘৃণা লালন করেছে দখলদারদের বিরুদ্ধে ।
ইথাকার মত দেশ আমাদের বাংলাদেশ তখন দখলদারদের কাছে বন্দী , এই সংক্ষুদ্ধ সময়ে প্রয়োজন একজন প্রকৃত বীর । টেলেমেকাস এখানে অসহায় জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে ,টেলেমেকাসের মতন এখানের মুক্তিকামী জনতা প্রতীক্ষা করে সে সাহসী বীরের যিনি আসবেন তিনি একজন পিতার অবয়বে যিনি এই অবোধ জনতাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মুক্তির ।
কবির আকুলতা ব্যথিত হয়ে আকাশ ছুঁয়ে যায় -
তুমি কি এখনো আসবে না?
স্বদেশের পূর্ণিমায় কখনো তোমার মুখ হবে না নাকি উদ্ভাসিত,
পিতা, পুনর্বার? -
১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান যার প্রতিবাদে আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন যাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমানও। কবি ক্ষুদ্ধ হয়ে লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা 'বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা'।
শুধাই ‘ওগো বর্ণমালা এত লাল মেখে তুমি
কোথা হতে এলে।’
অভিমান ভরা কণ্ঠে
ক খ গ ঘ
ওঠল বলি ‘তবে তুমি কি সেই ইতিহাস গেছ ভুলে?’
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন 'আসাদের শার্ট' কবিতাটি ।
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো, কিংবা সুর্যাস্তের
জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট
উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায় ।
একটা সাধারণ শার্ট অসাধারণ হয়ে ইতিহাস হয়ে আলোড়িত করে এদেশের মুক্তিকামী জনগনকে এবং মুক্তিকামী জনতার প্রতীক হয়ে যায় আসাদের শার্ট কবিতাটি -
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা, কলুষ আর লজ্জা,
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে । এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা 'স্বাধীনতা তুমি' ও 'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা'।[
স্বাধীনতা তুমি
শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা
স্বাধীনতা তুমি
পতাকা-শোভিত শ্লোগান-মুখর ঝাঁঝালো মিছিল।
(স্বাধীনতা তুমি )
কবি শামসুর রাহমানের কবিতা মানে রাজনীতি , স্বাধীনতা , নাগরিক জীবনের গভীর  অনুভুতি ।   একধরণের মোহে তিনি আচ্ছন্ন থাকেন ।
অনুভব করেন এই পৃথিবীর প্রতি , মানবীর প্রতি ভালোবাসা -
ঘোরে ঘোরে আচ্ছন্ন কবি রচনা করেন ভালোবাসার সব অসাধারণ কবিতা ।
ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এবার আমি
গোলাপ নেবো।
ফিরতে হ’লে বেলাবেলি হাঁটতে হবে
অনেকখানি ।
ভালোবাসা ছাড়া তো মানুষ বাঁচতে পারে না ।  দেশের প্রতি ভালোবাসা , মানুষের প্রতি ভালোবাসা , প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা তাঁর কবিতাকে স্বাতন্ত্র্যতা দান করেছে । নাগরিক কবি হিসেবে তিনি দুই বাংলায় বিখ্যাত হয়েছেন তবু তিনি প্রেম এর মধ্যেই ডুবে ছিলেন ।
বিদেশী ভাষায় শুধু তিনটি মায়াবী শব্দ, 'খুব
মনে পড়ে।' শব্দ এত চুম্বন-প্রবণ হতে পারে
কখনো জানি নি আগে ।
প্রেমের কাছে তাঁকে অসহায় রূপেই আমরা দেখি, যদিও তিনি নগরকবিদের সম্মেলনে উপস্থিত হন তেজি যুবরাজের মতো, নিজের জন্য রচনা করে নেন, দ্বৈপায়নতা - ‘স্বকীয় গোপন ঘুলঘুলি’, যার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টিপাত করেন নীলিমার বিস্তারে ।
'রঞ্জিতা, তোমার নাম, এতকাল পরেও কেমন
নির্ভুল মসৃণ মনে পড়ে যায় বেলা অবেলায় ।
রঞ্জিতা, তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কোনো এক
গ্রীষ্মেও দুপুরে দীপ্র কবি সম্মেলনে
কলকাতায় ন বছর আগে, মনে পড়ে?


বিষাদ তাঁর কবিতায় এসেছে আবশ্যিক ভাবে । সহজ সরল সাধারণ শব্দ অথচ কি অমায়িক । নরম শব্দ দিয়ে তিনি কবিতায় মায়াজাল ছড়িয়ে দেন ।
তাঁর  ‘দুঃখ’ কবিতায় কোনো বিবাগী বৈরাগ্য বা মরমিরূপ নেই, নেহাতই তা - দুঃখের জাগতিক গার্হস্থ্যে লেপ্টে থাকে বড়জোর ‘
নীল আকাশের
মিহি বাতাসের
সুন্দর পাখির মতো’ কমনীয় হয়ে ওঠে, তবু কিছুটা হলেও দুঃখের সর্বব্যাপ্ত মসৃণ রূপটি  দর্শন করে আত্মার শিহরণ অনুভবের বীক্ষা লাভ করা যায় । আমাদের মনে হয়, কবি এভাবে মরমীয় / অধিবিদ্যাকে  চিন্তার বাইরে অবস্থান করতে আগ্রহী ।
‘কবিকে দিও না দুঃখ’ - এই নিষেধ আর্তিতে আছে  দুঃখময় জীবনের বাইরে কবিকে থাকতে দেওয়ার প্রার্থনা । কবি শামসুর রাহমান বরাবরই তাঁর আকাংখা -এষণা-প্রত্যাখ্যান-প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন নম্রভাষণে, বিষাদময় স্বরে ।
রাহমানের কবিতায় রোম্যান্টিক জগতের জন্যে একটি গোপন হাহাকার আছে। অর্ধবিকশিত বুর্জোয়ার কাব্যসংস্কার যেন গোপনে বহন করে ওই জগতের খানিকটা বিভূতি ।
সীমাহীন রিক্ত আর বান্ধববিহীন কবি নিজেই বিষাদ হয়ে রেস্তোরাঁয় বসে থাকেন, এ যেন প্যারিসীয় নগরশিল্পীর পরিমণ্ডল । ক্রমাগত নগর হয়ে-ওঠা ঢাকার রাস্তা-ফুটপাত-পার্ক-রেস্তোরাঁ নিয়ে কবির  অবশেসন রয়েছে। তাঁর সুবিনীত কৃতি  হচ্ছে নগরের ছিন্ন , বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিমানুষের শ্রেণিপরিচিতির বাইরে গিয়ে তাদের একাকিত্ব, স্বাদ-সাধ আর আস্পৃহ অবলোকনকে কবিতা ভুক্ত করা - সে সাথে  মিলেমিশে আছে চিত্রকলার আঙ্গিককে বিজড়নের নান্দনিক উৎসাহ, প্রতীচ্য নগর দৃশ্যের অনুপুঙ্খ রূপটি ঢাকার প্রতিবেশে ফুটিয়ে তোলার আগ্রহ । সেইসঙ্গে বোদলেয়রীয় বিষাদ-নিঃসঙ্গতা অবধারিত হয়ে ওঠে ।
শামসুর রাহমানের কবিতায় মিথ; বিশেষত গ্রীক মিথের অসাধারণ তৎপর্যপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে । টেলেমেকাস, আফ্রোদিতি, ইকারুশ, ইলেক্ট্রা, ডেডেলাস, অ্যাগামেনন, অ্যাকিলিস প্রমুখ গ্রিক পৌরাণিক চরিত্রসমূহ রাহমানের ভাবনায় নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। যেমন- ‘ইকারুশের আকাশ’ কাব্যের বিখ্যাত কবিতা ‘ইলেকট্রার গান’ গ্রিক পুরাণের অভিশপ্ত অ্যাট্রিয়ুস রাজবংশের বিখ্যাত বীর অ্যাগামেনন ও তার কন্যা ইলেকট্রার ছায়াবলম্বনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (অ্যাগামেনন) ও কন্যা শেখ হাসিনাকে (ইলেকট্রা) কেন্দ্র করে রচিত ।
অন্তর্বর্তীকালীন রাজা ক্রেয়নের স্বৈরতান্ত্রিক আদেশে যখন যুদ্ধাহত ভ্রাতা পলিনাইসিসের লাশ সৎকারহীন পড়ে থাকে, তখন মৃত্যুদণ্ডাদেশ অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যায় অকুতোভয় আন্তিগোনে। সৎকার করে লাশ । এই আন্তিগোনেকেই কবি আহ্বান করেছেন একাত্তরের বাংলাদেশে; যেখানে অগণিত যুদ্ধাহত স্বদেশী ভ্রাতার সৎকারহীন মৃতদেহ শেয়াল-কুকুরে ছিঁড়ে খাচ্ছে। কবির ভাষায়-
আন্তিগোনে দ্যাখো চেয়ে-
একটি দুটি নয়কো মোটে,
হাজার হাজার মৃতদেহ
পথের ধুলোয় ভীষণ লোটে।
মিসরীয় কিংবদন্তির বিখ্যাত ফিনিক্স পাখির জীবন ট্রাজেডি নিয়ে রচিত হয়েছে ‘মাতাল ঋত্বিক’র ‘ফিনিক্সের গান’ এবং ‘হরিণের হাড়’র ‘পুরাণের পাখি’ কবিতা দুটি। ফিনিক্স পাখি, যে কিনা নিজের জ্বালানো আগুনে আত্মাহুতি দেয় আবার সেই ছাই  থেকে পুনর্জীবন লাভ করে । এবং জীবনযাপন শেষে প্রতিবার  একই কাজ করে সে । এই ফিনিক্স পাখিকে কবি প্রতিস্থাপন করেছেন নব্বই দশকের প্রগতিশীল আন্দোলনে নিহত ছাত্রনেতা রাজুর চরিত্রে । নিহত হলেও রাজুর মতো প্রতিহিংসার আগুনে পোড়া মানবতার পুজারী ফিনিক্স পাখিরা বারবার ফিরে আসে পৃথিবীতে। রাহমান বলেন ,
ওরা তোমাকে যতই পুড়িয়ে ভস্ম করুক হিংসার আগুনে,
তুমি বার বার আগুন থেকে বেরিয়ে আসবে পুরাণের পাখি।
(পুরাণের পাখি/হরিণের হাড়)
‘অস্ত্রে আমার বিশ্বাস নেই’
গ্রন্থের শেষ কবিতা ‘টাইরেসিয়াসের মতো’।
টাইরেসিয়াস গ্রীক নাটকের বিখ্যাত ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা।


'রাহমানের কবিতায় নারী প্রতিবেশিনী, সহচরী, ভীরুপ্রেমিকা, শরীরসর্বস্ব ইত্যাকার ভূমিকায় কখনো কাম্যরূপিণী, কখনোবা অধস্তন অস্তিত্ব । তারা শুধু কবির কাঙ্ক্ষিত নয়, কবিও তাদের প্রার্থিত । কিন্তু কবি অধরা হলেও নারীর সত্তা নিজের কাছেই স্পষ্টতা পায় না ।
তাঁর কবিতায় নারীকে এখানে আমরা ঊর্ধ্বতম সত্তা/ absolute-কে বাদ দিয়ে ভাবতে পারি তার অনিশ্চিত সত্তাকে - যাকে হাতের মুঠোয় ধরা যায় না ।
দীপ হাতে সেই অভাবের সংসারে
সত্যি মিথ্যে যদি ফিরে যাই হঠাৎ সেখানে তার
বিবর্ণ খেলাঘরে
সে কি আর ভাঙা পুতুল কুড়াবে
কাকডাকা রাতে একা?'
কবি শামসুর রাহমানের নিভৃত চেতনায় রোমান্টিসিজমের গূঢ় অস্তিত্ব খুবই প্রীতিস্নিগ্ধ নিবিড় । তারই উন্মোচন ঘটে তাঁর প্রকৃতি ভাবনায় আর অনেকাংশ জীবনানন্দীয় কাব্য-সংস্কৃতি ও প্রতিমা-অনুষঙ্গের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ।
কবির নিজের জীবনই হয়ে উঠবে কবিতার বিষয় আশয় - এই রকম একটা সুর
উঠেছিলা পশ্চিমবংগে । আত্বজৈবনিক স্বীকোরোক্তি মূলক কবিতার এই চর্চা শুরু হয়েছিল সেখানে পঞ্চাশের দশকে ।
শামসুর রাহমানের কবিতাতে সেই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় ।
স্বীকোরক্তির ভঙ্গিমায় তিনি অবলীলায় সব কথা বলে যান কবিতায় । অনেক বেশী আত্বজৈবনিক, মানবিক আর ব্যক্তিক হয়ে ওঠে তাঁর কবিতা ।। এবং বাংলাদেশের মূল ভাষা কাঠামোকে আশ্রয় করে বলে আন্তরিক এবং নান্দনিক । এর ফলেই তিরিশের দশকের কবিদের থেকে তিনি আলাদা এবং তাঁর ভিন্ন রকম সহজ শব্দের ব্যবহারে তাঁকে আলাদা করে চেনা যায় ।
যৌথ জাতিগত আকাংখা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর লেখার মায়াবী ছোঁয়ায় । শুধু বাংলাদেশের নয় পশ্চিম  বাংলার কবিতায়ও  অনন্য অভূতপূর্ব এক কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন শামসুর রাহমান  ।