কবিতার রস সব ফুরিয়ে গেছে,
হেভি মেটাল শুনে আর মাথায় রক্ত ওঠে না।
রবীন্দ্রসংগীতের সুরে বাজে না মনের বাঁশী।
সব যেন বিষ, সব!


শিল্পীর তুলি, তাঁর ক্যানভাস,
তাঁর আঁকা দূরবর্তী গাঁয়ের ছবি,
সবই পানসে লাগে।
রংধনুর রঙে খুঁজে পাই কেবল একটাই রং,
লাল, রক্তলাল রং।


পার্কে, রাস্তায় প্রেমিক-প্রেমিকার চোখে-মুখে দেখি মিথ্যে প্রতিশ্রুতির আদান-প্রদান।
সবার চোখেই স্পষ্ট দেখা যায় লোভ আর ধোঁকার বাস্তব ছবি।
সে ছবিরও জৌলুস হারিয়ে গেছে,
ধোঁকার মধ্যেও এ যেন আরেক ধোঁকা!


ইচ্ছে করে, গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দেই,
কাঁপিয়ে দেই সেই শুদ্ধতার ভিত,
যে অজস্রবার ধোঁকার সম্মুখীন হয়েছে,
ভেঙে-গড়ে যা আজ কৃষ্ণবর্ণের নিথর পাথর হয়েছে।


পুকুর পাড়ের দুরন্ত কিশোরদের চোখে-মুখেও আমি লোভ দেখি, ঘৃণা দেখি,
দেখি ধোঁকা দেবার সেই দুর্নিবার চাহনি।
ফসল কাটার পর যখন সেই মাঠে ছেলে-মেয়ের দল খেলা করে,
ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি,
সব খেলাতে আমি একটা খেলাই দেখি,
নিজেকে নিজেই ধোঁকা দেবার খেলা।

স্কুল শেষে ঘরমুখো গ্রাম্য বালক যখন ইচ্ছে করেই পথ ভুলে যায়,
প্রকৃতির প্রেমে পড়ে বাড়ি ফেরে অনেক পরে,
সেই প্রকৃতি প্রেমেও স্পষ্ট দেখি ধূর্ততার ছাপ।
আলো-আঁধারি সন্ধ্যায় যখন পাড়ায় পাড়ায় আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা
রূপকথার গল্পে মজে থাকে, ভুলে যায় বাস্তবতা
     সেখানেও দেখি সকলের লোভাতুর দৃষ্টি,
আর দেখি নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের বৃথা প্রচেষ্টা।


নদীর পাড়ের অসহায় বালক যখন ছোট্ট একটা মাছ ধরেও খুশিতে আটখানা হয়,
তার মাঝে সবাই দেখে নির্মলতা,
নিষ্পাপ মুখ আর প্রশান্তির ছায়া
ঠিক তখন আমি দেখি মিথ্যে অভিনয়, মেকী আনন্দ।


রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা জীবনানন্দ
কিংবা ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী বা ইয়েটস্ এর কাব্যে
সবাই দেখে সরলতা, মানব বন্দনা,
আর আমি এখানেও খুঁজে পাই চরম ধূর্ততা।


মিথ্যের মায়াজালে পতিত হয়ে যখন সব দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই,
তখন দেখি নিজের প্রতারণা, নিজের সাথে নিজের ধূর্ততা।
শুক্লপক্ষের রাতে যখন সবাই জোসনা দেখে বিহ্বল হয় আমি দেখি অপর পাশের অন্ধকারকে,
যে অন্ধকারকে কেউ গ্রহণ করতে চায় না,
মিথ্যের আলো দিয়ে সবাই ঢেকে ফেলতে চায় যাকে।

নতুন প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া প্রেমিক প্রেমিকার ফিসফিস কানাকানি কথোপকথনে
আমি শুনি কাল কেউটের ফোঁসফোঁস শব্দ।
  যখন একজন আরেক জনকে আবেগ নিয়ে বলে,
   "তুমি শুধু আমার" - হয়তো আমি তা শুনতে পাই না;
কিন্তু তারা এসবই বলছে ভেবেই হেসে কুটিকুটি হই,
তাদের চোখে ভালোবাসা দেখি না আমি, দেখি কামনার আগুন,
যে আগুনে জল দিলে বরং আগুন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।


স্বামীর জন্য হাতে খাবারের থালা নিয়ে বসে থাকা
গ্রাম্য কৃষাণবধুর চোখে-মুখেও মেকী তৃপ্তির ছাপ আমি দেখি,
মিথ্যে দেখি, স্ফটিক স্বচ্ছ!
সেখানে কোনো শুভ আশার লেশও আমি দেখি না,
দেখি না কৃষকের প্রতি তার ভালোবাসা,
দেখি কেবল কৃষকের দৃষ্টি এড়িয়ে তার নিজের স্বার্থসিদ্ধির সমস্ত আয়োজন করা।

বুকে আশা পুষে যে বালক মাথায় ফেরি নিয়ে রাস্তায়, গলিতে সারাদিন ঘুরে বেড়ায়
সে বালকও বোধহয় জানে না কি মিথ্যে আশা নিয়ে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হয়তো জেনেও না জানার ভান করছে সে।
আমার কাছে এ-ও এক ধূর্ততা!


অর্থহীন সবেতেই অর্থ খুঁজে পাই, অনর্থ খুঁজে পাই আমি।
আর তাই দিয়েই গড়ে ওঠে আমার অন্তরের মহাকাব্য,
আদতে যার কোনই অর্থ নেই, শুধু ভর্ৎসনা-প্রাপ্তি ছাড়া।


সবাই অভিনয় করে,
এই প্রকৃতি; মাঠ, ঘাট, আকাশ বাতাস, নদী, পুকুর...
শিশু, অবুঝ, পাগল...
রোগে আক্রান্ত শীর্ণ দেহের শয্যাগত যুবক কিংবা বৃদ্ধ,
কিংবা হাতে পবিত্র গ্রন্থ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভণ্ড ধার্মিক।
সবাই ধূর্ত, সবাই একই ভাগাড়ের বাসিন্দা,
মিথ্যেয়, ধোঁকায় জর্জরিত ধ্বংসস্তুপে পড়ে থাকা এক নষ্ট সমাজের বাসিন্দা।


জানি এ ধ্বংসস্তুপ চিরদিন এমনই থাকবে।
সে তার জীবনী-সুধা পাবে ধোঁকার মাঝে, মেকীর মাঝে।
জীবন নেবে, জীবন দেবে, জীবনকে ধ্বংস করবে... আবার গড়বে,
আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে মিথ্যেকে প্রতিষ্ঠিত করবেই।
তাই আমার আশা নেই।
কারণ, আমি জানি, মিথ্যের কোনো মৃত্যু নেই।
মিথ্যা চির অমর।


  মিথ্যাকে আলিঙ্গন করেই ধোঁকার রাজ্যে হওয়া যায় রাজাধিপতি।
মিথ্যা চির অমর, মিথ্যা চিরঞ্জীব,
মিথ্যা সত্যের চেয়েও সত্য!


জুন ২৮, ২০১৭