গেঁজেল মহারাজের কথা অমৃত সমান ।
পাপীরা সব ইগনোর্যান্ট, শোনে পুণ্যবান ।।


এক দেশে এক রাজন ছিলেন, চন্দ্রবর্মা নাম ।
বীর-কেশরী, প্রজাবৎসল, মহা কীর্তিমান ।।
গোয়াল ভরা গোরু আর বাগান ভরা গাছ ।
গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ ।।
হাতিশালে হাতী ছিল, ঘোড়া আস্তাবলে ।
প্রজারা সব সুখে ছিল, চোর-ডাকাতে জেলে ।।
রাজন ছিলেন পিতৃসম, সবাই বাসে ভালো ।
একটিমাত্র দুর্বলতা, রাজকন্যা আলো ।।
আলোকুমারী দুর্মুখ অতি, অতীব সুন্দরী ।
জন্ম থেকেই মাতৃ হারা, বেচারি মুখপুড়ী ।।
প্রশ্রয় পায় বাপের কাছে, মানুষ আয়ার হাতে ।
রেগে গেলে ভীষণ মূর্তি, হাতে মাথা কাটে ।।
রাগের কারণ তুচ্ছ অতি, না বোঝা যায় ভালো ।
সর্বদা সে বাগিয়ে খাঁড়া, সুযোগ পেলেই হল ।।
রাজন সবার প্রিয় পাত্র, প্রজারা নিঃশঙ্ক ।
এড়িয়ে চলো রাজকুমারী, সে যেন এক আতঙ্ক ।।
মেয়ে তার প্রাণের সমান, দোষ দেখেন না কোনও ।
আর সবেতে বিচার নিপুণ, মেয়ের বেলায় অন্ধ ।।


দেখতে দেখতে বছর গড়ায়, আলো অষ্টাদশী ।
চন্দ্রবর্মা তলব করেন “কোথায় রাজ-জ্যোতিষী” ?
পাঁজি-পুঁথি বিস্তর অতি, করে ঘাঁটাঘাঁটি ।
রাজ-জ্যোতিষী অবশেষে হাসেন মিটিমিটি ।।
“সুসংবাদ শুনুন রাজন, রাখতে বংশের ধারা ।
বসন্ত পূর্ণিমায় কন্যে হবেন স্বয়ম্বরা ।।
ঢাক বাজে, ঢোল বাজে, রাজ্যি জুড়ে সানাই ।
বিয়ের যুগ্যি রাজকুমারী, পাত্র কোথায় পাই ।।
দিকে দিকে খবর গেলো রাজ-রাজড়ার ঘরে ।
আসুক যত রাজকুমারেরা পক্ষীরাজে চড়ে ।।
রাজন ভাবেন আহা আমার মা মরা মেয়ে ।
ঠাকুর তুমি দেখো ওকে, একটুকু মুখ চেয়ে ।।
প্রজারা ভাবে, আহা তবে সত্যি সুদিন এলো ।
প্রাণটা এবার বাঁচবে বুঝি, কার যে কপাল পুড়লো ।।


দেখতে দেখতে এসে গেল দোল পূর্ণিমা তিথি ।
আজকে তবে ভরবে বুঝি আলোকুমারির সিঁথি ।।
কখন আসবে রাজার কুমার, সঙ্গে আনবে কি কি ?
কোথাও কিচ্ছু যায় না দেখা, কারুর কোন টিকি ।।
আস্তে আস্তে খবর আসে নানান রাজ্য হতে ।
কত রকম অজুহাত আর কত কারণ বটে ।।
কেউ বা ব্যস্ত, কেউ অসুস্থ, কেউবা বাগদত্ত ।
কোথাও থেকে আসছে না কেউ, এটাই হল সত্য ।।


নানান গুজব, নানান ভার্সন রাজ্য জুড়ে ওড়ে ।
ফিসফিসানি সুদিন তবে এলো না আর ফিরে !!
রাজকুমারীর মেজাজ কারুর জানতে বাকি নাই ।
রাজ্য জুড়ে নৈঃশব্দ্য, বাজে না আর সানাই ।।
রাজা ভীষণ, অধোবদন, ভাবেন দিনে রাতে ।
এ কি হল? কোথায় গলদ ? কেন আমার সাথে ?
আমার পরে কি যে আছে সোনামণির ভাগ্যে ?
পরলোকেও সুখ লেখা নেই, গেলামই বা সগ্যে !!


অনেক ভেবে ডাকেন রাজন কোর কমিটি মিটিং ।
পোশাকি নাম “লিডারশীপ কানেক্ট” সংগে ফ্রি ইটিং ।।
মন্ত্রী আছেন, কোটাল আছেন, আছেন সেনাপতি ।
রাজামশাই অস্থির বড়, ভবঃ স্থির মতি ।।
অনেক ভেবে, অবশেষে করেন প্রস্তাবনা ।
করলে বিয়ে রাজ্য পাবে সঙ্গে রাজকন্যা ।।
একদিকেতে ভালোই হল, কন্যে মোর একটি ।
বিয়ের পরে থাকবে ঘরে, পুষবো ঘরজামাইটি ।।
এবার বল মন্ত্রী, কোটাল কিম্বা সেনাপতি ।
কার পুত্র ? কে কিনবে? “টিকিট রাজ্যপতি”?
সবাই থাকে অধোবদন, কয় না কথা কেউ ।
আপনি বাঁচলে বাপের নাম – ছেলে কি আমার ফেউ ?


বোঝেন রাজন সবার মনন, নেইকো কারুর সাধ ।
এবার তবে স্বয়ম্বরে সবার প্রবেশ অবাধ ।।
ঘোষক করে ঘোষণা “এবার শুনুন সবাই সাফ ।
ভাবী জামাই বিয়ের পরে রাজ্য পাবে হাফ” ।।
কেই বা আছে দিচ্ছে যেচে গিলোটিনে মাথা ।
বেটিং চলে জোরকদমে কে সে বলির পাঁঠা ।।
প্রাণটা বেঁচে থাকলে পরে রাজ্য পেয়ে লাভ ।
সেটাই যদি আনসার্টেন, করো মোরে মাপ ।।
সকাল গেলো দুপুর গেলো প্রত্যাশায় রাজপুরী ।
রাজকন্যা থাকেন বুঝি হয়ে আইবুড়ী ।।


গিরিধারীর জ্যেষ্ঠপুত্র, চন্দন নামবর ।
কূট-বুদ্ধি, স্মার্ট, সর্ব শাস্ত্রতে তৎপর ।।
সৌম্য, শান্ত, গম্ভীর ধর্মে রাখে মতি ।
দিনশেষে কহিল এসে “হব কন্যের পতি ।।
রাজা সহ গুরুজনে প্রণমিলো নন্দন ।
আশীর্বাদ করে সবে দিলেন আসন ।।
প্রার্থী দেখে কৌতূহলে বসেন হেলে-দুলে ।
কি সৌভাগ্য বাবা আমার লক্ষ্মীমন্ত ছেলে ।।
রাজন বলেন জানিনা বাপু তোমার বাধ্যকতা ।
শুভকার্যে দেরি করা চরম মূর্খতা ।।
রাজ-জ্যোতিষী হেঁকে বলেন কেটে গেছে বিঘ্ন ।
আজি সন্ধ্যায় আছেন যেন বিবাহেরি লগ্ন ।।  


উলু ধ্বনি, শঙ্খ ধ্বনি, সানাইয়ের মদিরতা ।
রাজকুমারী অবশেষে হলেন পরিণীতা ।।
সুষ্ঠ মতন মিটল বিয়ে, সবাই পেল স্বস্তি ।
বাসর ঘর সখীতে পূর্ণ, বেজায় রকম মস্তি ।।
বর বাবাজী গম্ভীর অতি, কয় না কথা একটি ।
এমন সময় ডাক পড়লো, ডিনার পর্ব রেডি ।।
জামাই রাজা বসেন খেতে, ঘিরে অনেক মাথা ।
স্ত্রী খাওয়াবেন নিজের হাতে, এটাই কূল-প্রথা ।।
নিজের হাতে আলোকুমারি করেন পরিবেশন ।
দশ রকমের মৎস্য আর সঙ্গে পঞ্চ-ব্যঞ্জন ।।
মিষ্টি আছে বিশ রকমের, পায়েস নলেন গুড়ের ।
পুরী জুড়ে বাজছে সানাই মিষ্টি অনুরাগের ।।


ভুলু হল দুষ্টু অতি রাজকুমারীর পোষ্য ।
হাবে ভাবে শয়তানিতে মালকিনেরই শিষ্য ।।
দুর্বিনীত অহংকারী বদমাইশের ধাড়ি ।
বাঘের মাসি মাছের দিকে এগোয় গুড়িগুড়ি ।।
হঠাৎ থেমে বাবাজীবন বলেন মার্জারটিকে ।
“প্রথমবার করলাম বারণ, এগোস না এদিকে” ।।


সবার মুখে ভ্রুকুঞ্চন, সবার মনে ভয় ।
আলোর মুখ থমথমে, বুঝি আসছে বিপর্যয় ।।
চন্দন তবু ভ্রুক্ষেপ-হীন খাদ্যতে বিভোর ।
বেয়াদব মার্জার এটি, শুনবে না শিওর ।।
অন্ন ঘৃত শেষ করে তোলেন ডালের বাটি ।
এমন সময় পাজী বিড়াল এগোয় গুটিগুটি ।।
আবার থেমে শান্ত স্বরে বলেন তনয় ।
“দ্বিতীয়বার করলাম বারণ, তৃতীয়বার নয়” ।।


রাগে রক্তিম চাঁদের মতন রাজকুমারীর মুখ ।
ভয়ে সবার ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে বুক ।।
দুষ্ট বুদ্ধি মার্জারটি তুচ্ছ করে আদেশ ।
এইবারেতে টার্গেট করে আস্ত বাটি পায়েস ।।
ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ বাবাজীবন দাঁড়ায় আচম্বিতে ।
কাটলো বিড়াল দ্বিখণ্ডিত তরবারির কোপেতে ।।


হায় হায় করে ওঠে, আকুল সকলে ।
না জানি কি আছে আজ পতির কপালে  ।।
বেঘোরে প্রাণটা গেলো বেচারা চন্দন ।
ফিসফিসিয়ে বলল ছিল যত বৃদ্ধজন ।।
কাঁপছে মন্ত্রী, কাঁপছে সেপাই, কাঁপছে দাসদাসী ।
থরথরিয়ে কাঁপছে ভয়ে আলোর পিসি-মাসি ।।
ভুলু যদি পড়লো কাটা ক্রুদ্ধ রাজকুমারী ।
কোমরে জড়ায়ে আঁচল উঠিল ত্বরা করি ।।
এর কি অর্থ, ঘোর অনর্থ, কি করিলি স্বামী ।
এইবেলা পাষণ্ড কে বিনাশিব আমি ।।
আতপ্ত মুখ রাজকুমারীর দেখিয়া আচরণ ।
ভ্রুকুটি করিল নন্দন, রক্তিম নয়ন ।।
বজ্র কণ্ঠে বিজ্ঞাপিল গিরিধারি তনয় ।
“প্রথমবার করলাম বারণ, দ্বিতীয়বার নয়” ।।


শুনতে পাই রাজকন্যে সারাজীবন আর ।
পাগল নাকি? এর পরেও কেউ মুখ খোলে আবার !!
এরপরেতেই শুরু প্রথা, বিয়ের রাতে বিড়াল কাটা ।
মানতে চাইলে মানতে পার, নইলে তুমিই বলির পাঁঠা ।।