শোষণ-নিপীড়ন-নির্যাতনের কান্না যায় কি শব্দে লেখা?
যে কান্নার শেষে বিজয়ের হাসি তা কাব্যে হোক দেখা।  
‘হাতে বিড়ি মুখে পান লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’
তথাকথিত মুসলমানদের মুখে ধর্মান্ধের স্লোগান।
শয়তানের সব শয়তানি হার মানালো পাকিস্তানি,
জিন্নাহর সব কুটচাল যে হলো না তো জানাজানি,
দ্বি-জাতি তত্ত্বের ধোঁয়া তুলে ঐক্যের হয় অবসান,
আর উপমহাদেশ ভারত ভেঙ্গে হলো যে খান খান,  
সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত বাংলা, শেরেবাংলার আন্দোলন
‘কলকাতা রক্ষা’ ব্যর্থ, বাংলা বিভাজনের শেষ ক্ষণ।
করিমগঞ্জ সিলেটছাড়া হলো, দার্জিলিংটাও এলো না,
আসাম-কলকাতা গেলো, বাংলাদেশ তা পেলো না।
যে বাংলার মানুষের দেয়া ভোটে এলো পাকিস্তান
সেই মানুষের মুখে হতাশা, ফের মুক্তির পথে টান।
আট মাস পার হয়ে গেলো, মেলেনা জিন্নাহর দেখা,
প্রতারণা, শোষণ, বঞ্চনা যে কপালের উপর লেখা।
আট মাস পর জিন্নাহ এলেন, সবার মনে নব আশা,
জিন্নাহ বলেন, পাকিস্তানে একমাত্র উর্দুই রাষ্ট্র ভাষা!
দল গঠন হয়‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম’ নামে
ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী, শামসুলের দেশপ্রেমের খামে।
‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম’ দল গঠন করে
সোহরাওয়ার্দী এবার মানুষের ভাষা নিলেন উচ্চে ধরে।
এ দেশের মুখে যে মায়ের ভাষা তা জীবন থেকে বড়,  
জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে সে ভাষার মানকে রক্ষা করো।  
প্রতিবাদে মুখর ঢাকার সড়ক, ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’
রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত প্রাণ ঝরালেন তাই।
শেরে বাংলার প্রতিবাদী হাত নতুন এক দলকে গড়ে
‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’ নিয়ে জনতাকে দেন সাহসে ভরে।
ঐতিহাসিক নির্বাচন হলো, মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়,
যুক্তফ্রন্টের বিশাল বিজয় এলো, শেরেবাংলার বাংলা জয়।
পরের ক’বছরে বেশ জটিল হলো সব প্রতিবাদের ছন্দ,
পশ্চিম পাকিস্তানে ষড়যন্ত্র আর এ বাংলায় নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে মারামারি-আক্রমণ
প্রতিবাদের আগুন চুপসে যায়, পাল্টে যায় তার ব্যকরণ।
শেরে বাংলার ইহধাম ত্যাগ, এরপর শরিফ শিক্ষা কমিশন
বাংলায় ফের আগুন জ্বালায়, শুরু ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন।    
বৈরুতে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর রহস্যের গন্ধ বেশ ছড়ায়,
আন্দোলন আরো তীব্র হলে তা পাকিস্তানের বুক নাড়ায়,
আইয়ুব খান জয় করলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির পদ,
কূটচালে আর ঝুটঝামেলায় বাঁধালেন তিনি বড় বিপদ।  
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেঁধে গেলে বাংলার ভাগ্যে শনি,
তাসখন্দ চুক্তিতে যুদ্ধ শেষ, আর আইয়ুবের পরাজয় ধ্বনি।  
তাসখন্দ চুক্তি জায়েজ করতে গোল টেবিল বৈঠক ডাকা,
শেখ মুজিবও উপস্থিত, তাই ছয় দফা দাবিটাও হলো হাঁকা।  
শেখ মুজিবের দাবির মুখে আইয়ুবের চোখ রাঙ্গানিই রবে,
তিনি বললেন, অস্ত্রের ভাষায় ছয় দফার জবাব দেয়া হবে।
পূর্ব পাকিস্তানে মুখে মুখে যখন জনপ্রিয়ত ছয় দফা দাবিটার  
পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রে তখন শেখ মুজিব হন গ্রেফতার।  
শেখ মুজিবসহ অনেকেই বিদ্ধ হন পাকিস্তানের সন্দেহ-তীরে
তাঁরা নাকি আগরতলা বৈঠক করেন স্বাধীন বাংলা ইস্যু ঘিরে।
বানোয়াট আগরতলা মামলা হলো, গ্রেফতার হন অনেক নেতা,  
ভাসানির নেতৃত্বে আন্দোলন তীব্রতর হলো পূর্ব পাকিস্তানে,
অন্যয় মামলা-হামলা, অহেতুক গণগ্রেফতার কেউ না মানে।
পুলিশের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ, শাসক বেসামাল,
সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার পর পুরো পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল।  
ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতা নিলেন, আইয়ুবের পতন,
পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় দেশব্যাপী নির্বাচন।  
‘একমাথা একভোট’ নীতি ছড়াতে পারেনি ভীতি একটি বার,
ভাসানির নির্বাচন বর্জনেও আওয়ামী লীগের যে জয় জয়কার।  
‘বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী,’ ঢাকায় বলেন ইয়াহিয়া,
বিরোধী দলে বসতে রাজি নন ভুট্টো, বাঁধ সাধতে হন মরিয়া,  
ভুট্টোর বিরোধিতায় পুরো তাল মেলান পাকিস্তানী জেনারেলগণ,  
ক্ষমতা হস্তান্তরে অহেতুক দেরি, ক্ষমতা হারাতে তারা রাজি নন।
৭’ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ‘বাংলার মানুষ মুক্তি চায়’
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ উত্তাল হয়ে ছড়িয়ে যায়।
৯-এ মার্চ ভাসানি-আতাউর খান সে হাওয়ায় দেন অগ্নি ঝাঁক,
বঙ্গবন্ধুর পর তাঁরাও দিলেন পূর্ণ স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক।
ইয়াহিয়া খান ঢাকা এলেন, মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে নেই গতি,
এক ব্যর্থ বৈঠকের আড়ালে পাকিস্তানীদের ব্যাপক যুদ্ধের প্রস্তুতি!
২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে শুরু হলো সকল মাবনবতার ভঙ্গ ক্ষণ,
নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর পাকিস্তানী সেনাদের অতর্কিত আক্রমণ।
মানলো না মানবতা, মানলো না সভ্যতা, মানা হলো না যে ধর্ম,
হত্যা হলো, রাহাজানি হলো, হলো ধর্ষন, হলো যতো অপকর্ম।
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ হলো, তিরিশ লক্ষ প্রাণ গেলো বয়ে রক্তঢেউ,
তিন লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম গেলো, পুড়ে ছাই হলো কেউ কেউ।
শত্রুপক্ষের আত্মসমর্পণ হলো, হলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের পরাজয়,    
পৃথিবীর মানচিত্রে হলো একটি নতুন স্বাধীন দেশের উজ্জ্বল অভ্যুদয়।
সুকান্তের ভাষায়, ‘সাবাশ বাংলাদেশ! এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়
জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’ হার মানবার নয়।