কবি বেগম সুফিয়া কামালের ১০৬তম জন্মদিন


নারী জাগরণের পথিকৃৎ জননী সাহসিকা কবি বেগম সুফিয়া কামালের ১০৬তম জন্মদিন আজ। ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।


সুফিয়া কামাল ছিলেন মানবতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে এবং যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার একজন সমাজসেবী ও নারী নেত্রী। তিনি ছিলেন বাংলা ভাষার বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতি কর্মীদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন।


মা সাবেরা খাতুন আর বাবা সৈয়দ আবদুল বারীর পরিবারে এই মহীয়সীর জন্ম। নানার দেওয়া নাম সুফিয়া খাতুন। সুফিয়ার বাবা যখন সাধকদের অনুসরণে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন, তখন সুফিয়ার বয়স মাত্র সাত মাস। স্বামীর নিরুদ্দেশ যাত্রা, শ্বশুরবাড়িতে নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, অনেকের বিরূপ মনোভাব সব মিলিয়ে সাবেরা খাতুন অনেকটা বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। সুফিয়া বড় হয়েছেন তার নানার বাড়িতে।


যে সময়ে সুফিয়া কামালের জন্ম তখন বাঙ্গালি মুসলিম নারীদের কাটাতে হত গৃহবন্দি জীবন। স্কুল কলেজে পড়ার কোন সুযোগ তাদের ছিল না। পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ এক রকম নিষিদ্ধ ছিল। ঐ বিরুদ্ধ পরিবেশে সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। তিনি পারিবারিক নানা উত্থান পতনের মধ্যে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। ঘরের মধ্যেই আরবির পাশাপাশি শিখতে শুরু করেন বাংলাভাষা। আর তখন থেকেই শুরু হয়েছিল কবিতা লেখা ও পড়ার ঝোঁক।


সুফিয়া কামাল তার মা সাবেরা বেগমের কাছে বাংলা পড়তে শেখেন। ১৯২৪ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাত ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে সুফিয়ার বিয়ে দেওয়া হয়। নেহাল অপেক্ষাকৃত আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সাহিত্যপাঠে উৎসাহিত করেন। বিয়ের সময় সৈয়দ নেহাল হোসেন ছিলেন স্কুলের ছাত্র। বিয়ের পর বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এন্ট্রাস ও এফএ পাস করে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। সেন্ট জেভিয়ার্স এ পড়ার সময় সৈয়দ নেহাল হোসেন সস্ত্রীক কলকাতার তালতলায় এক বাসায় থাকতেন। কলকাতায় অবস্থান করার সুযোগে কাজী নজরুল ইসলাম, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, লীলা রায়, শামসুন নাহার মাহমুদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎ লাভের অভূতপূর্ব সুযোগ লাভ করেন সুফিয়া কামাল। যা তাকে সাহিত্যচর্চায় আরও অনুপ্রাণিত করে। শুধু তাই নয়, স্বামীর উত্সাহ উদ্দীপনা ও সর্বাত্মক সহযোগিতায় সুফিয়া বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করতে লাগলেন; এমনকি কংগ্রেস সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। সুফিয়া কামালের শিশু মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল বেগম রোকেয়ার কথা ও কাজ, সুফিয়া কামালের কাজেকর্মেও ছাপ পাওয়া যায় বেগম রোকেয়ার।


১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে রোকেয়া হল নামকরণের দাবি জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতিপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাসভবন সংলগ্ন গোটা ধানমন্ডি এলাকা পাকিস্তানী বাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে ছিল, আর ওই সময় তিনি ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিরাপদে অবস্থান করেন।


স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কার্ফিউ উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।


১৯৩২ সালে স্বামী নেহাল হোসেন আক্রান্ত হলেন দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ১৯ ডিসেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তাদের একমাত্র কন্যা আমেনা হোসেন দুলুর বয়স মাত্র ৬ মাস। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে সুফিয়ার জীবনে নেমে আসে চরম দুর্যোগ ও দুর্ভোগ। এই সময়ে সবকিছু বিবেচনা করে সুফিয়া নিজেই উপার্জনের সিদ্ধান্ত নেন। মূলত এখান থেকেই তার ব্যক্তিজীবন ও সাংগঠনিক কর্মকান্ডে দুর্যোগ মুহূর্তে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সূত্রপাত। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় উপার্জনের উপায়ের প্রশ্নে। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সার্টিফিকেট তার ছিল না। এরকম দুর্যোগময় দিনে তাকে দারুণভাবে সহায়তা করেন কলকাতা কর্পোরেশনের তৎকালীন এডুকেশন অফিসার শ্রীযুক্ত ক্ষিতীশ প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিজ উদ্যোগে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে সুফিয়াকে শিক্ষকতার চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। পঞ্চাশ টাকা মাইনের এই শিক্ষকতার চাকরি তখন সুফিয়ার জন্যে ছিল পরম পাওয়া। তিন মাসের মধ্যে সুফিয়া নিজ যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে শিক্ষয়িত্রী পদে স্থায়ীভাবে বহাল হন।


১৯৩৯ সালের ৮ এপ্রিলে চট্টগ্রামের কামালউদ্দিন খানের সঙ্গে সুফিয়ার পুনঃবিবাহ হয়। বিবাহের পর তিনি সুফিয়া কামাল নামে পরিচিত হলেন। উচ্চশিক্ষিত সুদর্শন কামালউদ্দিন খান ছিলেন অত্যন্ত চিন্তাশীল ব্যক্তি। বিয়ের পর তিনি সুফিয়ার কাব্য প্রতিভা বিকাশের প্রতিই বেশি যত্নবান ছিলেন। তিনি কবির লেখা সংরক্ষণ, পান্ডুলিপি তৈরি ইত্যাদি সযত্নে করতেন। এ পরিবারে জন্ম নেন ছেলে শাহেদ কামাল (শামীম), আহমদ কামাল (শোয়েব), সাজেদ কামাল (শাব্বীর) এবং মেয়ে সুলতানা কামাল (লুলু) ও সাঈদা কামাল (টুলু)।


সাহিত্য পাঠের পাশাপাশি সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা বাসন্তী সেসময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়। মুসলিম নারীদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামে রোকেয়ার সঙ্গে সুফিয়া কামালের পরিচয় হয়। বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা ও প্রতিজ্ঞা তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, যা তার জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।


সাহিত্য ক্ষেত্রে রবীন্দ্র-নজরুলের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে উজ্জীবিত ও তাদের প্রশংসায় ধন্য হয়ে নারী মুক্তি আন্দোলনে বেগম রোকেয়ার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার গৌরব নিয়ে এবং দেশবাসীর মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে নিজেই যেন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছেন বেগম সুফিয়া কামাল।


সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সুফিয়া কামালের সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে। ১৯৩৭ সালে তার গল্পের সংকলন কেয়ার কাটা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাঁঝের মায়ার মুখবন্ধ লিখেন কাজী নজরুল ইসলাম। বইটি বিদগ্ধজনের প্রশংসা কুড়ায় যাদের মাঝে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।


সুফিয়া কামালের লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগন্থের মধ্যে রয়েছে সাঁঝের মায়া (১৯৩৮), মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), শান্তি ও প্রার্থনা (১৯৫৮), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), দিওয়ান (১৯৬৬), মোর জাদুদের সমাধি পরে (১৯৭২)। গল্পের মধ্যে কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭), ভ্রমনকাহিনী সোভিয়েতে দিনগুলি (১৯৬৮), স্মৃতিকথা একাত্তুরের ডায়েরি (১৯৮৯) উল্লেখযোগ্য।


সাহিত্যচর্চার জন্য অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন প্রথিতযশা এই কবি। ৫০টির বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। এর মাঝে কয়েকটি বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), সোভিয়েত লেনিন পদক (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৭৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯২), জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫), দেশবন্ধু সি আর দাস গোল্ড মেডেল (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পদক (১৯৯৭)।


কবি, বুদ্ধিজীবী, সমাজনেত্রী, নারী ব্যক্তিত্ব এবং নারী জাগরণের পথিকৃৎ কবি বেগম সুফিয়া কামাল ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ৮৮ বছর বয়সে তার জীবনাবসান হয়। আজিমপুর কবরস্থানে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে সুফিয়া কামালই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন।


আজ এই উজ্জ্বল নক্ষত্রের জন্মদিনে রইলো অগাধ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।


*তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট