গ্রীষ্মের শেষ অহনকলেবর
অধীরে যেতেছে ভাঙি--
যেমন করি অশ্মের 'পরে
অশ্ম মনুষ্য টুকরে আঘাত হানি!
অহির সাক্ষাত্ নাহি মিলে অদ্য
স্থাপিছে থাকি আপনায়--অন্তরালে,
ধূসরাম্বুদ রহিছে ছত্রসম ব্যাপিয়া
অস্বচ্ছ করিয়াছে বিস্তৃত ধরাতলে!
গরজে উঠিছে অম্ভোদাদ্রি
সৃজিছে অম্বরে সৌদামিনী,
রাজত্বিছে ক্ষণকাল নীলদ্যুলোকে
অপাংজ্যোতি প্রকাশি ক্রুদ্ধ আপনি!
নীরদছানা চলিছে ভাসি
অম্বরার্ণবের বিস্তৃত বীথি ধরি,
অমিখিয়া কল্পি অম্বুতালদল
নৃত্যিয়া চলিছে পুলক ভরি!
হেরি ক্ষণপ্রভা মানসমাঝে
উঠিছে এক প্রসূণ বিকশি,
অপাংজ্যোতিসম এ-হেন জনম
কিয়ত্পরে অর্মত্য দেয় যে নাশি!
অসম্বরচিত্ত আর তিষ্ঠিতে নারে
হেরিতে না ইচ্ছে নভ:মণ্ডলে,
সেই হেতু ক্ষ্মার 'পরে করি নেত্রপাত
হেরিতে ইচ্ছে মৃণ্ময়ী মায় আঁখিযুগলে!
নৃত্যিছে দ্রুমরাজি সমীরণবেগে
উঠিছে শ্রুতিমধুর মর্মরধ্বনি,
কিশলয়গুলি পুলকে হরষাচ্ছন্ন
নবীনজীবন বচন যাই শ্রবণি!
কীটাবাস হইয়া রহিছে তরুরাজি
বিবিধ বিহঙ্গম সৃজিছে বাসা,
কত চোখাচোখি কত কথোপকথন
উভয়ের মাঝে কত প্রীতিভালোবাসা!
শুষ্কপর্ণ আপন ইচ্ছার বিরুদ্ধে
তরুতলে আঁখিলোরে গেছে ঝরি,
তাই তো নবীনরূপ লাভিয়া
শ্যামল কিশলয় গিয়াছে ভরি!
তরুশাখে অসুমার বিহগকুজন
সৃজিছে কাকলি বিবিধ খেচরে,
না ত্যাজি নীড় তুলিছে মিশ্রতান
চঞ্চুপুটে স্পর্শে নাই কোনো টুকরো আহারে!
শাখে-প্রশাখে তারা ছন্দে দোলে
উদরে ব্যাপিছে তীব্র ক্ষুধানল,
শিশুদের আঁকড়ি বসিছে মায়
নিরবধি ঝরিছে সদা বর্ষণজল!
কখনও নারিকেল-খেজুরশ্রেণি
ঘুরাইছে স্বশির চারসমকোনে,
কারও শ্রবণিতেছি ক্রন্দনধ্বনি
হাস্য সৃজিছে কেহ হরষিত মনে!
ছুটিছে স্রোতোস্বতীর খরবেগধারা
দখিন হতে ঠিক উত্তরাভিমুখে,
পাড়যুগলে শরণিছে ঢেউরাশি
হেরি আমি তাহা মোর কর্ণচোখে!
কূলকূলধ্বনি যায় যে ভাসি
কোন সুদূরের নীল নীলাম্বরপানে,
গীতিছে বায়ু গীতিছে নদী
ধরা মুখরিত উভয়ের সংকর গানে!
ক্ষুধিত এক বক একপাদ উঁচি
আছে দাঁড়িয়ে অভ্যাশ জলার পাড়ে,
বায়ুবেগে সেই জলার বারিও
আপনার বেগে ছন্দে আছড়ে পড়ে!
অস্বস্তিতে গেছে ভরি সে হায়
নির্যাতিত যে সে অসহনীয় শীতলতায়,
আহারিতে তাকে দিতেছে বাধা
ক্রুদ্ধাবেগের শীতল দক্ষিণবায়!
শীর্ণ মাল্লা এক জীর্ণ তরণী
বাহিয়া চলিছে পশ্চিম হতে,
নগ্নদেহী অযোত্র সে হায়
চিন্তিয়াছে সে নানাবিধ সারা রাতে!
প্রাতে ধরি মত্স্য অধিক
করিবে বিক্রি সে মত্স্যাড়তে,
তা বেচি চাল-ডাল কিনি
হৃষ্টচিত্তে সে পশিবে আপন বাড়িতে!
তিন তনয় আর তনয়াযুগল
আর উভয়ে--দুই স্বামীস্ত্রী,
ভক্ষিবে আহার--অন্ন-ব্যাঞ্জন
আপন ক্ষুধিত উদর লইবে ভরি!
সে-গুড়ে বালি চলিতে নারে
দক্ষিণাভিমুখে--সুদূর দখিনপানে,
কেমনে শীর্ণ কায়া করিবে মোকাবিলা
আসলে সে তো চলিছে উজানে!
অর্ধনগ্নকায়া হইয়াছে শীতল
শিহরিত গাত্রে দিতেছে কাঁটা,
ফিরি আপন আবাসপানে
কোথায় পাইবে আহারচ্ছটা!
অস্ফূট ব্যথা ব্যাপিয়া আপনায়
নাকিঞ্চন মানবেরে লইয়াছে গ্রাসি,
বদন আছে, ওষ্ঠ বিরাজমান
কিন্তু,বিন্দুকনাকারেও নাই তো হাসি!
বাহির হতে আমি এলুম
আমার আপন শীর্ণ নিবাসপানে,
আসন পাতি পড়িলাম বসি
বায়ুবয় এক দখিন-বাতায়নে!
শীতল পবন অপাদমস্তক--কলেবর
মোর যায় যে গ্রাসি,
গাত্রকম্পন সহসা করি হায়
মোর মাঝেতে উঠিছে ভাসি!
অঙ্গভঙ্গি মোর নহে আলোল
চঞ্চলালি তুলিছে গুঞ্জণধ্বনি,
কলেবরপ্রসূণ্যোদ্যানে বিচরে--ভ্রমে
যেতেছে স্বাগ্রহে-- আপনাগ্রহে গানি!
প্রত্যুষে কিছুই হয়নি ভোজন
সেই হেতু হায় অমুদৃশ দশা,
আহারিতে কখন ভুলিয়া গিয়াছি
শ্রবণিতে,উপলব্ধিতে প্রকৃতির ভাষা!
বারিতে তন্ময়িত কিয়ত্ অন্ন
পূর্ব অহনে হয়েছিল পাক,
তাহা দিয়াই কোনোরকমে
পূর্ণ করিলাম উদরের ফাঁক!
তারপর পুবদিকের দাওয়ায়
উপাধানখানি টানিয়া লয়ে
বংশরচিত মাচার উপর
শ্রান্তকলেবরে পড়িলাম শুয়ে!
সহসা করি--দৈবাত্ দৈবাত্
শীতল সমীরণ যায় মোকে চুমি,
তাই মনে হয় শীতলরাজত্বে
আটকে আমি গেলাম যে থামি!
পাদের অভ্যাশ হালকা কাঁথা
লইয়া দিলাম গাত্রেতে মুড়ি,
কত অসুমার অমৃষা স্মৃতি
যেতেছে মোর মানসে পড়ি!
এই পুস্তকের পৃষ্ঠাগুলি হায়
আপনার আগ্রহে চেপে
বাস্তবতার বিশাল বপু
প্রকৃতিকে আরেকটু নিলাম মেপে!
অনিমেষ লক্ষ্যে নেত্রযুগলে
বাহিরেতে আমি দিলাম ছুটি,
বিবিধ দৃশ্য অক্ষিপটে মোর
নীলাব্জসম গো উঠিল ফুটি!
আপন নীলদল দিল বিকশি
সুমধুর বায়--সমীরণে,
এতদিন তারা আপনাদের ঢাকি
রহিয়াছিল অতিসংগোপনে!
ভাবি বারিতে কর্দমাক্ত
হইয়া গেছে বাহিরের বীথি,
কেমনে আমি বাহিরিব বাইরে
প্রতিকূলতা অদ্য মোর সাথী!
পথে-মাঠে-ঘাটে ধূলিকনারাশির
জ্ঞাত নহে কততম হল শেষ
জীবন তাদের,এখন তাদের
নেই তো দেখা--বিন্দু মাত্র লেশ!
বাহির হতে--আকাশ-বাতাস হতে
চিত্তরে বাহুপাশিয়া লইলাম টানি,
বামপার্শ্বে অতিযতনে স্থাপিয়াছিল
রবির গড়া "সোনার তরী"খানি!
বাহির করি "পুরস্কার" গো
আয়তনে তাহা কৌতূহলে পড়ি,
শুরুতেই হেরি অনর্গল বর্ষণধারা
মানসখানি মোর যে উঠিল নাড়ি!
তাহার পরে টিপিয়া ধরিলিম
গভীর মনোযোগের সুকুমার টুঁটি,
বলছিলাম তায় "দীর্ঘমুহূর্ত
আমা হতে তুমি পাবে না ছুটি!"
স্বাগ্রহে তারপর হরষিত চিত্তে
করিলাম "পুরস্কারে" আঁখিপাত,
নয়নযুগলে ধরি "পুরস্কার"
হতেছে মম সেই সময়পাত!
হেরি,কোনো এক কবি সৃজিতে ব্যস্ত
ছন্দবদ্ধ এক দুর্লভ কবিতা,
কবিস্ত্রী আসি স্থাপিল হেথা
ভিঞ্চির সেথার নীরবতা!
তারপর দোঁহারে কথোপকথন
সে-কথা আমি কী আর যে কব,
"সোনার তরী" লো করেতে করি
পাইয়া যাবে সমস্ত--সব!
যেই উচ্চারি উঠিল চিত্ত
"ভারতীরে ছাড়ি ধরো এই বেলা
লক্ষ্মীর উপাসনা" ছাড়ি
"ছন্দ দীর্ঘ হ্রস্ব" এমন খেলা
অমনি দৈবাত্ ব্যথা করে বুক
শয্যা হতে পড়িলাম উঠি,
ক্ষণকালের তরে আপন শয্যারে
অকপট চিত্তে দিলাম যে ছুটি!
রাখিয়া রবির সৃজনখানি
বসিয়া পড়ি চেয়ারের 'পরে,
কী যেন,কে যেন বারংবার
মোর হৃদিতে আঘাত করে!
তারপর একে একে অসুমার স্মৃতি
যে-দিকে হেরি উঠিছে ভাসি,
সহসা যেন লক্ষ দাবানল
উপভোগিছে বো কে ত্বরা আসি!
মুখ মোর মূক হয়েছে একেবারে
আঁখি ব্যস্ত করিতে অশ্রুমোচন,
অবিরামধারা বহিয়া চলিছে
কী প্রকারে ইহা করিব সংবরণ!
উঠিছে ভাসি সেই মিষ্ট বদন
মুক্তা সৃজনে আগ্রহী হাসি,
কত কোটি বত্সর চিনি উহারে
দিয়ে গেল মোকে কত কিছু আসি!
দক্ষণহস্তরে দিলাম অনুমতি
লুকাইতে নোনাজল--অশ্রুধারা,
জ্বালা করি উঠে দু'নয়ন মোর
অশ্রুতে নেত্রযুগল টুইটম্বুর ভরা!
অকস্মাত্ হেরি আসি পাশে বসি
শুধায় মোকে আপন মায়
"কেন কাঁদিস এত বড়ো ছেলে?
ফিরে না সে যে একবার যায়!"
ঈষত্ লজ্জায় লজ্জিত হইয়া
দিলাম আসনকে মোর ত্যাজি,
বাহির হলেম রবির অন্বেষণে
কিয়দাগে চিত্তকে করেছি রাজি!
কুহেলিকাসম ব্যাপিয়া জলদ
নাই তো রবির একটুও দেখা,
কী জানি মা ধরিত্রী ললাটে
এমনটাই কি ছিল লেখা!
------------সমাপ্ত--------------
16ই মার্চ,2015