**** (কথা-কাহিনী) ****


অতি নির্মম কষ্টেও এই চোখে আসেনি জল
আজ চোখে এল জল আঝোর ধারায়
হায়! এ কি নিষ্ঠুর বিচার বিধাতা!


যে বছর পূর্ণগ্রাস সূর্য্যগ্রহণ হল
সে বছর ওর মায়ের ব্যাথা উঠল
লাগল গ্রহণ, জন্ম হল ঘাতক পুত্রের
পুত্রের জন্ম আর মায়ের জীবনাবসান,
ওর বাপটা গেল পাগল হয়ে!
নবজাতকের নামকরণতো দূরের কথা
হাসপাতালে ওর মুখ দেখেনি কেউই!
অগত্যা আমাকেই নিয়ে আসতে হল
দত্তক পুত্রের জননী হলাম সেদিন,
বিদ্রুপ উপেক্ষা করে নাম রাখলাম গ্রহণ’
সেই থেকে এই মাসির ঘরে মানুষ
সবাই তাকে দূর দূর করলেও
‘গ্রহণ’ ছিল আমার নয়নের মনি।


চার বছর পর একটি মেয়ে জন্মাল
ওর খেলার সঙ্গী হল আমার খুকী,
হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে ওরা বাড়তে লাগল
একদিন মেয়ের কম্প দিয়ে জ্বর এল,
গ্রহণ স্কুলে গেল একা একাই –
ওর মেসো স্কুল থেকে বাড়ি আনতে গিয়ে
রাস্তা পার হওয়ার সময় পড়ল গাড়ির তলায়
সবাই বলল ওটাকে ঘর থেকে বার করেদে
ওই গেরোই সবার জীবনে অন্ধকার আনবে
সেদিনও আমার চোখে জল ছিল না !
যাই ঘটুক না কেন, আমিইতো ওর মা
সেকথা ভুললে চলবে কেন !
চোখের জল চোখে শুকিয়ে গেল
তারপর কঠিন জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে
ওদের দুজনকে বড় করতে লাগলাম।
কখনও কখনও দেখতাম গ্রহণ একাই
হতাশ মুখে নির্জনে বসে কাঁদছে –
খুকী ডাকলেও তার সাড়া মিলত না।


খুকীর বয়স যখন ষোল পার হয়েছে
আবার এল এক অভিসপ্ত সময়
ধরা পড়ল মেয়ের কিডনী বিকলের সংবাদ,
আমি দিশেহারা হয়ে ছুটতে লাগলাম
গ্রহণ বললে মা’গো আমি সব ঠিক করে দেব।
নিজের শরীরের একখণ্ড মাংসপিণ্ড দিয়ে
ছোট বোনের জীবন বাঁচাল সে,
সেদিনও আমার চোখে জল আসেনি একফোঁটাও।


মাঝেমধ্যে ওর পাগল বাপটা আসতো টাকা নিতে
ছেলেকে দেখতে পেলেই গালিগালাজের অন্ত থাকতো না,
খুকী যেদিন বাড়ি ফিরল ঠিক সেদিন
বাপের মুখে অকথ্য ভাষার প্রকাশ পেল গ্রহণ !
তারপর আরোও পাঁচ বছর কেটে গেছে –
সেদিন ছিল দোল পূর্ণিমার সকাল
রঙের মেলায় মেতে উঠেছে সবাই
গ্রহণের কোন ইচ্ছা করেনা রঙ খেলার,
ওর বোন এসে দাদার মুখে দেয় রঙ
মুখখানা বাঁদুড়ে রঙ দেখে আমি হেসেছিলাম
কি জানি ছেলের বুঝি রাগ হল তাতে
ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল বাইরে –
যখন ঘরে ফিরল তখন বুঝিনি ওর মতলব
আমাকে ডেকে আবির দিতে গিয়ে
ওর হাত দুটো আমার চোখের মধ্যে বাঁদুড়ে রঙে ভরিয়ে দিল;
অসহ্য যন্ত্রণায় যখন আমি ছটফট করছি
সবাই তখন ওকে তেড়ে মারতে গেল,
আজ যখন হাসপাতালে আমি চোখ খুলছি
দেখি আমার সামনে বসে কাঁদছে
খুকী আর গ্রহণের পাগল বাপটা,
আমি কিছু বলার আগেই খুকী কেঁদে বলল –
দাদা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে অনেক দূরে
রেখে গেছে তার নিশানা তোমার চোখে,
প্রহারের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে
পালাতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে
আর ওর পটেক থেকে পাওয়া গেছে এই চিরকুট –
তাতে লেখা : ‘মা’গো আমার জন্য সবার কষ্ট,
সবার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার ,
তাই আমি নিজেই চাই প্রবল অন্ধকার,
শুধু শেষ দিনও যেন তোমার আদরকুটু পাই
চাই তোমার মধ্যে বেঁচে থাকতে !’