কবিতা মননের বিষয়। মননে যার রসবোধ আছে সে-ই কবিতা পছন্দ করে। কিন্তু সবাই কবিতা লিখে না, লিখতে পারে না। দৃষ্টি মেধা ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে যিনি কবিতা লিখতে পারেন তিনিই কবি। তাই কবি হন প্রজ্ঞাবান কিন্তু সব প্রজ্ঞাবানই কবি নন।


পবিত্র আল-কোরানের দিকে নজর করলে কী দেখতে পাই? প্রজ্ঞাময় এই গ্রন্থ বস্তুত প্রজ্ঞার আলোয় উদ্ভাসিত জ্ঞান-মাধুর্যে পূর্ণ এক মহান কাব্য! তাই এর ভাষা এতো উন্নত, এতো মধুর। আল-কোরআন তাই, শান্তি স্বস্তির এক ঐশ্বরিক নেয়ামকও। বহু প্রজ্ঞাবান আলেম-সাধকের নিরন্তর গবেষণায় এর পরিপূর্ণ বিশ্লেষণ আজো হয়ে উঠেনি, সম্ভবও নয়। অনন্তকাল বিশ্লেষণ করেও আল-কোরানের প্রজ্ঞার সীমানা নির্ধারণ করা দুষ্কর। কিন্তু অনুভবে আত্মস্ত করে আল-কোরান পাঠে শান্তি স্বস্তি মেলে।


অনেকেই বুঝতে পারে না যে, জানতে বা অজান্ত প্রায় প্রতিটি মানুষের মধ্যেই রয়েছে কাব্যবোধ। কাব্য চর্চায়ও প্রাণ-মন প্রসন্ন হয়। কাব্য চর্চায় দৃষ্টিভঙ্গি উদার হয়, স্বচ্ছ হয়, জ্ঞানের পরিধি বাড়ে। সুস্থ কাব্য চর্চা তাই জ্ঞানময় ও কল্যাণকর। কিন্তু তার জন্যে বেশি বেশি কবিতা চর্চা করা চাই। প্রযুক্তি জ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষতার যুগে এসে নানান কারণে তা স্তিমিত হয়ে আসছে কিন্ত কেন? সে কারণ আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে।


পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচলিত ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা চতুর্থতম ভাষা। বিশ্বে প্রায় ত্রিশ কোটি লোক বাংলায় কথা বলে। মায়ের মুখের এই গর্বিত ভাষায় কথা বলার গৌরবে আমিও গর্বিত। নমস্য সেইসব বীর শহীদদের – যারা বুকের রক্ত দিয়ে ভাষাকে সম্মানের আসনে বসিয়ে গেছেন। আজ আমরা সেই ভাষার গর্বিত ভাষাভাষী। এই ভাষার মর্যাদা রক্ষা করা - কবি-সাহিত্যিকদেরই কাজ - কোন সন্দেহ নেই। সুতরাং একমাত্র কবি-সাহিত্যিকরাই পারেন ভাষাকে চর্চায় রেখে এর অবস্থান সুসংহত করতে।


আমাদের ভাষাচর্চার পাদপ্রদীপ সেই চর্যাপদের যুগ (খ্রিস্টীয় দশম ~ দ্বাদশ শতাব্দী) থেকে মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলির হাত ধরে বঙ্কিমচন্দ্র, মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, কাজী নজরুল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, হুমায়ূন আজাদ, হুমায়ন আহমেদ প্রমুখ সহ অসংখ্য শক্তিমান যুগখ্যাত কবি লেখকদের লেখনীর মাধ্যমে বিবর্তিত হতে হতে বাংলা ভাষা আজকের রূপ পরিগ্রহ করেছে।


এই সময়ের মধ্যে সাহিত্যের বিবর্তনের পাশাপাশি ভাষাতেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। কিন্তু তাই বলে একে গায়ের জোরে কেউ চাপিয়ে দেননি বা রাতারাতি আধুনিক হয়ে উঠার জন্যে কেউ কাছা বেঁধে জেহাদও ঘোষণা করেননি। তবু বিগত হাজার বছরে অভাবিত পরিবর্তন এসেছে। এসেছে কালের বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই। এখানে জোরাজুরি বা চাপিয়ে দেয়ার মত কোন বিষয় ছিল না। পরিবর্তন যা এসেছে তা দিনে দিনে - কালের বাস্তবতায়, ধীরে ধীরে সময়ের পরিক্রমণে। ভাষাকে নিয়ে নিত্য-নতুন গবেষণা চলছে, তেমনি চলছে কবিতা নিয়েও। আজকের কবি-সাহিত্যিকগণ সেই বেগবান ধারাকে অব্যাহত রেখেই তাঁদের সাহিত্যচর্চা করে চলেছেন।


টিমটিমে মাটির প্রদীপ হলেও আমরা তাঁদেরই উত্তরসূরি। অগ্রজদের ঐতিহ্যের ধারক বাহক হিসাবে তাঁদের সৃষ্টি-প্রভার বিকিরণে আমাদের লেখনী যদি খানিকটা আলো পায় আর সে আলোয় অবগাহন করে আমরা ঋদ্ধ হবার সুযোগ পাই তাতে দোষের কী আছে? কিন্তু অধুনা অনেক উন্নাসমনন কবি বন্ধুকে যখন 'জাত গেল, জাত গেল' ধরনের বক্তব্য দিতে গিয়ে দেখি তাঁরা মৌলিক রচনার জন্য জিগির তোলেন তখন হতাশ না-হয়ে পারি না। স্বভাবতই তাঁদের মৌলিকত্বের স্বরূপ দেখতে তাঁদের যুগান্তরী রচনা পাঠ করতে গিয়ে দাঁত ভেঙে ফিরে আসতে হয়। তখন কবিতাকে অঙ্কের চেয়েও জটিল মনে হয়। আর একই কারণে সাধারণ পাঠক তো বটেই, কাব্য-রসিক কবিদের মাঝেও কবিতা পাঠে অনিহা বাড়ছে।


বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোন সুন্দর বোধ বা আবহের উপস্থিতি নেই। তার উপর অস্পষ্টতা ও অতিবিমূর্ত ভাবের চাদরে আবৃত থাকার কারণে ন্যূনতম কাব্যিক বোধ ও মেধার চর্চাকারী কবিদের মাঝেও স্বভাবতই সেইসব কবিতা পাঠে নিস্পৃহতা কাজ করে। তাহলে সাধারণ পাঠকের অবস্থা যে কী - তা সহজেই অনুমেয়। অনেক শিক্ষিতজনকেই আজকাল তাই কবিতার ব্যাপারে ব্যাপক হতাশ দেখতে পাই। তথাকথিত আধুনিক বা উত্তরাধুনিক মৌলিক সৃষ্টি(!) যদি পাঠককে বিভ্রান্ত করে বা কবিতার প্রতি নিস্পৃহ করে তোলে সেই দায় তাহলে কার?


অপরাপর অনেকের মতই আমারো জিজ্ঞাসা - কেমন হওয়া চাই কবিতার ধরন ধারণ? কেমন হওয়া উচিৎ কবিতার জমিন? কবিতা মনের খায়েসে লিখবো বটে, তবে কি তা কেবলই নিজের জন্য অথবা কোন বিশেষ গোষ্ঠীর জন্য?


না, তা যেন কখনো নয়। কবিতা হবে নরমে গরমে, কঠিন কোমলে, প্রেমে ও দ্রোহে ঝর্নাধারার মতই উচ্ছল বাঙ্গ্ময়, স্বপ্রতিভ। স্ববেগে বয়ে চলা নদীস্রোত যেমন কাউকে পরোয়া করে না। সে কাউকে তোষামোদ করে না। সে যেমন কারোর ইচ্ছার কাছে নিজেকে বিকোয় না আবার কারো সন্তুষ্টি বিধানও তার উদ্দেশ্য নয়। কবিতা যেন হয় তেমনি নির্ঝরিনীর বর্ণিল ধারা।


সুতরাং পিতৃপুরুষদের ভুলে গিয়ে নয় কিংবা অগ্রজদের পাশ কাটিয়ে নয় বরং তাঁদের পদচর্চিত পথই হোক আজকের কবিদের চলার পথের দিশা। কবিতার মাঠ উন্মুক্ত থাকুক আপামর জনসাধারণের জন্য। আঁতেল হোক, শিক্ষিত জ্ঞানী কিংবা অল্প শিক্ষিত পাঠক যে কারোর জন্যই কবিতার মাঠ সদা উন্মুক্ত থাকবে - এমনটাই হোক আজ সবার প্রত্যাশা।


----------------------------------------
বিনীত কৈফিয়ত:
আমার এই পোস্টটি যে এমন অলক্ষুণে হবে তা কী জানতাম? খুব দুঃখ হচ্ছে - আমার দুজন প্রিয়তম ও পরম শ্রদ্ধেয় কবির মাঝে অযাচিত ভুল বোঝাবুঝির সূত্রপাত হতে দেখে।


তাই, দুই প্রিয় কবির কাছেই আমার বিনীত আরজ - আমাকে মার্জনা করুন। স্বনামধন্য দুই বন্ধুর ভুল বোঝাবুঝির সহজ অবসানকল্পে দুজনার মন্তব্যগুলো মুছে দিয়েছি বলে। পাতায় আপনাদের অসামান্য অবদান ও আকাশ ছোঁয়া সুনাম বিঘ্নিত হোক তা আমি মেনে নিতে পারিনি।