‘শব্দ’ - ইংরেজিতে যাকে বলে Word/Sound । একজাতীয় তরঙ্গ (কম্পন বা echo) বিশেষ। মনের ভাব প্রকাশে ব্যক্ত বাক্যস্থিত পদের একক বা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। অর্থান্তরে এর নানান রূপ আছে যেমন; গর্জন (sound/noise/loud) ধ্বনি বা সুরধ্বনি (tune/tone/roar)। ভাষা প্রকাশের এক আদর্শ মাধ্যম –‘শব্দ’। সুললিত ‘শব্দ’ মানুষের মনে ও মননে আনন্দের সঞ্চার করে। যেমন; গান কিংবা কবিতার শব্দমালা মানব-চিত্তকে আনন্দ বিষাদের দোলায় আন্দোলিত করে।


এই ‘শব্দে’র প্রকাশ নানান ভাবেই হয়ে থাকে। কখনো তা চিত্তপ্রসারী, কখনো চিত্তবিদারী। ‘নাদ’ যেমন চিত্ত মনোরঞ্জনী তেমনি ‘নিনাদ’ বা ‘আর্তনাদ’ হলে তা-ই হয়ে উঠে চিত্তবিদারী। সুতরাং, বলা যায়, মানব চিত্তের সংকোচন বা প্রসারণের জন্য ‘শব্দ’ অনেকাংশেই দায়ী।


‘শব্দে’র প্রকাশ দুভাবেই হতে পারে - সশব্দ প্রকাশ কিংবা নিঃশব্দ প্রকাশ। ‘শব্দে’র সশব্দ প্রকাশ বায়ুস্তরে কম্পাঙ্ক তৈরি করে যা শ্রবণযন্ত্র (কান) গ্রহণ করে মানুষের মনে পৌঁছে দেয়। কিন্তু নিঃশব্দ প্রকাশ সরাসরি মননে কম্পাঙ্ক তৈরি করে। সুতরাং, ‘শব্দে’র নিঃশব্দ প্রকাশ মানুষের মন নিয়ন্ত্রণের প্রত্যক্ষ ও শক্তিশালী প্রভাবক। আবেগে কল্পনায় ভাবে ও প্রকাশে ‘শব্দে’র নিঃশব্দ প্রকাশ মানুষের চিত্ত চাঞ্চল্যের প্রভাবকও বটে। ‘শব্দে’র নিঃশব্দ প্রকাশ মানুষের মন-মননে, চিন্তা-ভাবনায়, সম্পর্ক তৈরি কিংবা সম্পর্ক ভাঙতে, আবেগ নিঃসরণে, কল্পনা সৃজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


একটি গান কিংবা কবিতার শব্দরাশি কখনো নদী বা সমুদ্রের মতই শব্দময় হয়ে উঠতে পারে। নদীর কুলুকুলু ধ্বনি, ঝিঁঝিঁপোকার সিঞ্চনী কিংবা বাতাসে ঝরা-পাতার মর্মর ধ্বনির শব্দগত অর্থ নেই বটে – আছে ভাব প্রদায়ী দ্যোতনা। এদের নীরব ভাষা সাদা অর্থে অর্থহীন মনে হতে পারে। সাধারণ্যে তা পাঠযোগ্য বা বোধযোগ্য নয়। একমাত্র ভাবুক মনই তা বুঝতে পারে।


আকাশের মৌনবাণী, রাতের নীরব ভাষা কিংবা পাহাড়ের কান্না সবাই শুনতে পায় না। এ যে নিতান্তই মননের কারবার। আর মননের কারবারী ভাবুক কবিরাই এসব নীরব ভাষার অর্থ বোঝেন। সেসবের নীরব পাঠে তাই তারা ভাবুক মানুষের মনে বিবিধ ভাবের চিত্র-মানচিত্র নির্মাণ করতে পারেন। কৌমুদি জ্যোৎস্নার নিঃশব্দ আলোরাশি মানুষের মনকে অতিন্দ্রীয় ভাববিহ্বলতায় স্নাত করে। তেমনি অমাবশ্যার নিকষ অন্ধকারের ‘শব্দ’ মানুষের মনে ভৌতিক কিংবা বিষাদের অনুভুতি জাগাতে পারে।


ভাব আদান-প্রদানের বাহক এই ‘শব্দ’ সাহিত্য-রসও তৈরি করতে পারে। ‘শব্দ’ যেমন আনন্দ দিতে পারে তেমনি বিষাদিতও করে তুলতে পারে। সুতরাং, বলা যায়, ‘শব্দ’ মানব জীবনে আনন্দ বেদনার এক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। কবিরা শব্দে শব্দে মালা গাঁথেন। শব্দের নানাবিধ প্রয়োগ ও কৌণিক অবস্থানে তৈরী হয় নান্দনিক কাব্যের অমর গাথা। আর এসব রচনা কণ্ঠশিল্পীর সুরের পরশ পেয়ে হয়ে উঠে আরো প্রাণবন্ত আরো জীবন্ত। শব্দের সাথে শব্দের বন্ধনে রচনা হতে পারে অভাবনীয় আনন্দ-ভুবন।


সভ্যতার সূচনা থেকেই ‘শব্দ’ মানুষকে সংস্কৃতিবান করে তুলেছে। আনন্দ-বিষাদের উৎস এই ‘শব্দ’ই ভাষাশিল্পের অনন্য কাঁচামাল। এ-দিয়েই কবি সাহিত্যিকরা কবিতা রচনা করেন, গল্প উপন্যাস লিখেন, গায়ক গান করেন। একজন চারু কিংবা কারুশিল্পী শিল্প রচনা করেন বস্তুগত কাঁচামাল ব্যবহার করে। কিন্তু একজন কবি শিল্প রচনা করেন অদৃশ্য কাঁচামাল প্রয়োগে – এই ‘শব্দ’ দিয়েই। অপরাপর শিল্পের সাথে এইখানেই কাব্যশিল্পের অনন্য পার্থক্য ও বিশেষত্ব। আর এই বিশেষত্বই কাব্যশিল্পকে করেছে অনন্য ও মহিমান্বিত।  


এবার ফিরে দেখি ‘শব্দে’র বিরূপ প্রভাব! ‘শব্দ’ যখন গর্জন বা নিনাদ – তা মানুষকে বিভীষিকায় তাড়িত করে। হৃৎকম্পন বাড়িয়ে মানুষকে অসুস্থও করে তোলে। ‘শব্দ’ মানুষকে মৃত্যুর মুখেও ঠেলে দিতে পারে। এই ’শব্দে’র তাণ্ডব মানুষের মনকে বিপথগামী করে তোলে, অহংকারী ও উন্নাসিক করে তোলে।


সাম্প্রতিক ধর্মাচারে, পূজা-পার্বণে, সভা-সমাবেশ সহ নানাবিধ সামাজিক অনুষ্ঠানে কিছু মানুষের অজ্ঞানতা তথা স্বেচ্ছাচারীতার ফলে জনজীবনে রুপিত হচ্ছে অদৃশ্য মৃত্যু ফাঁদ। বিজ্ঞানের আবিস্কার - এক বিশেষ ধরনের ‘সাউণ্ড সিস্টেম’-এর ব্যবহারে শান্তিপ্রিয় মানুষের দিনযাপনকে করে তুলছে অসুস্থ ও কন্টকাকীর্ণ। হাজার হাজার ডেসিবল শব্দচিৎকারে মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এইসব শব্দ-সন্ত্রাস হার্টের রোগী, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের জীবনকে করে তুলছে আতঙ্কিত ও বিপর্যস্ত।


এসবের দেখ-ভালের কেউ আছে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রযন্ত্র, সমাজ-সমীক্ষক কিংবা সমাজ-উন্নয়নমূলক সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ সবাই নির্বিকার, সবাই উদাসীন। এ বিষয়ে কেউ কিছু ভাবছে বলে মনে হয় না। যেন কারোরই কিছু করার নেই! তাই দিন দিন প্রতিযোগীতামূলক হারে শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার বেড়েই চলেছে। অথচ উন্নত বিশ্বে এসব নিয়ে ভাবা হয়, নিয়ন্ত্রণের চিন্তা করা হয়। আমাদের চিন্তা করার কেউ নেই।


শব্দের এই দূষণ রোধে কেউ যখন ভাবছে না সুতরাং, এর বিরুদ্ধে সমাজ সচেতন মানুষকেই সরব হতে হবে। আর শব্দদূষণ নয়, শব্দের কোন অপব্যবহার নয়, শব্দের শালীন ব্যবহারেই গড়ে উঠুক সুস্থ সংস্কৃতি – এই সত্যটিই অবিবেচক মানুষকে বোঝাতে হবে। সমাজকে ভালো রাখার জন্য এই বার্তাটির প্রচারে কবি-অকবি নির্বিশেষে সকল মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।


‘শব্দে’র পরিচর্যায় জীবন হোক সুষমাময়
অপ-প্রয়োগে যেন আর কোন হুমকি নয়।