আহ্নিক আবর্তে ঘড়ির কাঁটায় দিন-রাত্রির নিয়মতান্ত্রিক পরিক্রমণ সূত্রে আবার এসেছে পহেলা বৈশাখ। চৈত্রের অবসানে বসন্তের আঁচল ছুঁয়ে এসেছে নতুন বছর। এই নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ ঐতিহ্য গরিমায় বাঙালি সংস্কৃতির এক গর্বিত ধারা। আনাদিকাল থেকেই বাংলা সনের প্রথম দিনটি উৎসবে আনন্দে ‘নববর্ষ’ বা ‘পহেলা বৈশাখ’ নামে উদযাপিত হয়ে আসছে। জীর্ণ ক্লান্ত পুরনো বছরের রাত্রির অবসানে পূর্ব দিগন্তে উদিত হয় নতুন দিনের জ্যোতির্ময় ভানু। নিঃসর্গের উন্মুক্ত মঞ্চে ধ্বনিত হয় নব জীবনের নব সংগীত। দিগন্ত ছাড়িয়ে মাঠ-নদী-প্রান্তর ব্যাপী বসে প্রকৃতির আনন্দ-মেলা। অটবি-বিটপীর পত্র-পল্লবে ছড়িয়ে পড়ে এর পুলক শিহরণ। লতা-গুল্মে, গাছে আর পাখির ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের উচ্ছ্বাস লহর। দিকে দিকে চলে বর্ষ বরণের উৎসব আয়োজন।


বাঙালির নববর্ষ আর 'বৈশাখ' উচ্চারণের সাথেই যে নামটি অবশ্যম্ভাবী তা হ'ল আমাদের প্রাণের কবি - গুরু-ঠাকুর। তাঁকে ছাড়া নববর্ষ কিংবা বৈশাখ যেন` অসম্পূর্ণ। বৈশাখ নিয়ে তাঁর অনেক রচনার একটি থেকে কয়েক চরণ উদ্ধৃতি দিয়েই শুরু করছি আজকের নববর্ষের নিবেদন -


"হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!
ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,
তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল
কারে দাও ডাক
হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!"


বৈশাখ - বাংলা সনের প্রথম মাস। বৈশাখ বলতেই কবিগুরুর এই অবিনাশী কবিতাংশ আমাদের মননের নীড়ে ঢেউ তুলে যায়। আর “এসো হে বৈশাখ এসো এসো” গানটি তো বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রথম ও অন্যতম অনুসঙ্গ বিশেষ।


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈশাখকে আহবান করেছেন; জীবনের সব গ্লানি, সব জড়তা-দীনতাকে মুছে দিতে - "তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে।" তিনি বৈশাখকে দেখেছেন শোক-দুঃখ, হতাশা-যন্ত্রণা, জরা-মৃত্যু ও ক্ষুধা-তৃষ্ণা তাড়ানিয়া শক্তিরূপে। আবার আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর 'প্রলয়োল্লাস' কবিতায় বৈশাখকে আবাহন করেছেন - “তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নতুনের কেতন উড়ে কাল-বোশেখীর ঝড়।”


প্রতিটি উৎসবেই প্রাণের আবেগে মিলিত হয় সবাই, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ তখন এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। বাঙালির তেমনি এক চিরায়ত উৎসব পহেলা বৈশাখ - বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। পুরো জাতি সেদিন মেতে উঠে বৈশাখী উৎসবে।


বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ও সার্বজনীন উৎসব বলতে বাংলা নববর্ষকেই বোঝায়। বৈশাখের শিকড় বাঙালির মূলধারায় প্রোথিত। অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্যই বাংলা নববর্ষের উৎসব আজ জাতীয় উৎসব। এই উৎসবের বিচ্ছুরণ গ্রাম-বাংলা থেকে শহর-নগর-বন্দর ছাড়িয়ে ভৌগলিক সীমারেখা ভেদ করে আজ বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। পহেলা বৈশাখ; বর্ষবরণ উৎসব এবং বৈশাখী মেলা - তাই আজ এক সার্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক, ঐতিহ্যময় এবং বিশ্বজনীন উৎসব।


আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান ঐতিহ্য - চারু কারু কুটিরশিল্প নকশি ও তাঁত শিল্পের প্রদর্শন বিপণন সহ নবান্নের পিঠা-পুলি, খই-মোয়া, নাড়ু-সন্দেশ ইত্যাদির সমাহার এই উৎসবের অবশ্যম্ভাবী অনুসঙ্গ। পুঁথি পাঠ, জারি-সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, পালাগান, বাউলের একতারা-দু’তারা আর ঢোল-মৃদঙ্গের তালে বাঙালি প্রাণের উচ্ছ্বাসে মেতে বর্ষবরণ উৎসব পালন করে।


কবি, লেখক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বাঙালি জনগোষ্ঠির সবাই নিজস্ব স্বকীয়তা নানান উৎসবে আড্ডায় বৈশাখী মেলার শুদ্ধতায় ও ভালোবাসায় এক হবার প্রেরণা পায়। পহেলা বৈশাখ আমাদের সংলগ্ন হতে বলে, ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানায়। পহেলা বৈশাখ মানেই  মিলনের ও আনন্দের ঝর্নাধারা। সেই আনন্দকে আসুন আরো ছন্দময় ও অর্থবহ করে তুলি বাংলা কবিতা ও গানে। বাংলার লোকায়েত সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও উৎসব আমাদের প্রেরণার উৎস। কখনো কখনো আমরা হেরেছি বটে, কিন্তু এই হারাটাই শেষ নয়। হারতে হারতেই আমরা বিজয়ও ছিনিয়ে এনেছি।


“প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র, দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, যেদিন সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া বৃহৎ।” বিশ্বকবির এই উক্তির স্পিরিটে উজ্জীবিত হয়ে আসুন নতুন বছরকে সানন্দে বরণ করি।


বিশ্বকবির উক্তি থেকে ধার করে সবশেষে আবারো বলি - জগতের আনন্দ যজ্ঞে হোক আমাদের নিমন্ত্রণ। নববর্ষের কল্যাণময় শক্তিকে সুস্বাগত জানাই। সেইসাথে সকলের প্রতি রইল নববর্ষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা। শুভ নববর্ষ-১৪২৪।