শান্ত নদীর জল দেখলেই মনে পড়ে
ঘাঘট নদীর কথা, মনে পড়ে তুলশি গঙ্গার কথা।
কেমন সাদাটে স্বচ্ছ জল, আবার কোথাও
গভীরতায় কালচে। শীর্ণ স্রোতের অনুকূলে
নদীর গায়ে বেড়ে উঠা ডুবো গুচ্ছ ঘাস বন, সবুজ
শ্যাওলার অনুক্ষন মাথা দুলানি, ফাঁকে চিংড়ি, বাইলা,
পুঁটি মাছের লুকচুরি খেলা, অদুরে কানি বকের
শিকারি দৃষ্টিতে নিরন্তর প্রতিক্ষা, বড্ড মনে পড়ে।


শীতল হাঁটু জলের গায়ে চিত হয়ে শুয়ে
থাকতে থাকতে আকাশ দেখতাম, গায়ে জল
ছিটাতাম, শরীরের ভাঁজে সুড়সুড়ি দিত ক্লান্ত
বালি রাশি, দু একটা মাছও যে শরীর স্পর্শ
করত না তা নয়। কিন্তু সব কিছুকে উপেক্ষা
করে তবুও কান পড়ে থাকত নদীর কাছে, ওর
গভীর কান্নার কাছে, যে কান্নার জল অলক্ষে
মিশে যায় শরীরের জলে যা বেয়ে আসে উজান
থেকে আর কারও কান্নার জল হয়ে।


যেদিকটায় নেমেছি সেদিকটায় গত বরষার খাড়া
পাড়। এখনও আক্রোশ আর ভাঙ্গনের চিহ্ন দগ দগে।
সে পাড়ে বসতির কান্না, প্রকৃতির হাহাকার এখনও
আতংক ছড়ায়, চিৎকার করে ফেরে বেতসি বাতাস
চারিপাশ। এখনও ভীটাহীণ মানুষের দু চারটে বিরহী
দৃষ্টি গালের হাত হয়ে শক্তি খোঁজে, মায়া খোঁজে,
খোঁজে অস্তিত্তের শেকড়।


নদী আমাকে এ সবের গল্প শোনায়। গল্প শোনায়
কতবার কত পণ্য ভরা, মানুষ ভরা নৌকাডুবি, গবাদি
পশুর ভেসে যাওয়া, সাজানো বসত ভিটার ভাঙন,
ফসলি ক্ষেত, ফলের বাগান আপন বক্ষে ধ্বংস হতে
দেখে দেখে ভুলেই গেছে নিজের কান্না। এত ক্ষতি,
এত কষ্ট আহাজারি দেখে তার মনের ভেতর ব্যাথারা
ছোপ ছোপ দানা বেঁধে কষ্টের স্মৃতি হয়ে আছে।


নদী নিরুপায় থাকে। কেননা তার জন্মই যেন হয়েছে
আমৃত্যু ঘটনার সাক্ষী হয়ে বয়ে চলা। তবে ইদানিং তার
ভয় হয়, তার বুকে ক্লান্ত বালু রাশি তিলে তিলে যে ভাবে
মরছে, তাতে একদিন তাকেও না ইতিহাস হয়ে যেতে হয়-
এই খানে এক নদী ছিল এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতায়।


ইতিহাস হয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই সে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে,
জল গড়ায় চোখের ফল্গু ধারায়। আমাকে চারিপাশ থেকে
জড়িয়ে ধরে বলে, নদীরা যে ভাবে শুকে মরছে তার আগে
খগেন মাঝির বউয়ের কথা না বললেই নয়। আমাকে
শোনাতে চায় তার বিগত দিনের কষ্টের গল্প। আমি অধির
হয়ে ওর শান্ত শীতল জলে নিশ্চুপ কান রাখি।


নদী বলে-
ভোরের আলোর মত ফুটানি করা সংসার ছিল তার,
পোয়াতি বউটা খল খল করে হাসত নদীর ঘাটে
মাঝির পথ চেয়ে, সানকিতে ভাত বেড়ে কত স্বপ্ন
কথায় দোল খেয়ে যেত মাঝির নাও, গামছা ছেড়ে  
বউয়ের আঁচলটা টেনে নিত মুখ মুছার জন্য। তা দেখে
ঘাটের জল- বৈঠা আর নায়ের তলায় বাড়ি খেয়ে মুচকি
হাসত। আগামী স্বত্বার অপেক্ষায় মাঝি ভুলে যেত তার
সকল ক্লান্তি, মান-অভিমান, কষ্ট আর বিগত দুর্ঘটনাকে।


তারপর একদিন এক রাতে সর্বনাশা বানের  
জলে অমন সুন্দর বউটা পানিতে ভেসে মরল, শুধু কি
বউ, সাথে মানুষের মধ্যে আর একটা মানুষ মরল,
স্বপ্ন মরল, খগেন মরল, নদীর মধ্যে নদী মরল কেউ
জানল না। যেমন আমি প্রতি দিন মরছি কেবল মরছি
কেউ দেখলনা, কেউ জানল না কি ব্যাথায় কাঁদছে আমার
অবলা মন। আমার চোখে এখন কান্নারা শুকে মরে।


নদীর যন্ত্রণার কথা শোনার পর শান্ত নদীর জল দেখলেই
মনে পড়ে ঘাঘট নদীর কথা, মনে পড়ে তুলশি গঙ্গার কথা
আমার কানে এখন কেবলই ধ্বনিত হয়- মানুষের মধ্যে
আর একটা মানুষ মরল, স্বপ্ন মরল,নদীর মধ্যে নদী মরল
কেউ জানল না, কেউ দেখল না...