বাবার বৈঠকখানা এখন হয়েছে ড্রয়িংরুম। অথচ এই ড্রয়িংরুমে
আগে কত সময় কত মনের জায়গীরদাররা থাকতেন। সন্ধ্যায়
লন্ঠনের মৃদু আলোয় বসত আড্ডা। পাড়ার চাচা, মামারা আসতেন।
কখনও দাদু-নানুরা হুঁকায় ধূম্র নেশার আয়েশি দম মেরে টান
ধরতেন পুঁথি পাঠে। কখনও কখনও রাত গভীর হত সোনাভানের
কেচ্ছায়। কখনও ফিসি আড্ডা হত স্বাধীকারের।  


দেখেছি বাবার বৈঠকখানা ঘরে বসে তাঁরা ’৪৭ এর দেশ ভাগ,
গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন, হাজী দানেশের তেভাগা আন্দোলন,
’৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৫ এর পাক-ভারত যুদ্ধ, শেখ মুজিব
ইত্যাদি নিয়ে কত কথাই না বলতেন। আমার কিশোর মন তখন
তাঁদের কথার সেতু ধরে পাড়ি দিত দূর দূর সবুজ কোন অরন্য,
অধিকার বঞ্চিত নিরন্ন জনপদ, অন্তবিহীন সমুদ্র আর বেহাল পথ ঘাট
পেরিয়ে কোন মুক্ত স্বদেশ খুঁজতে।


স্বরবর্ণ, বেঞ্জনবর্ণের পরিচিত আসরও বসত ঐ জায়গীরদার শিক্ষকের
আয়োজনে।  কত দিন কত রাত, বৈঠকখানায় বাংলা ভাষার ধ্বনি নাচত
শিক্ষকের বেতের আগায় বাংলা ভাষার দাবীতে। তখন ’৫২ এর লালিত
গোপন আদর আর শহীদদের রক্তের প্রতিশোধ শিক্ষকের বেত্রাঘাতে
হয়ত ফুটে থাকত জ্বল জ্বল করে। এখন বুঝি কেন বাংলা বর্ণের প্রতি
শিক্ষক ছিলেন এত দরদী, কেন মা ডাকলে মাতাল হয় স্বর্গ-মর্ত্য।


তারপর আসে সেই ফুল ফোটার দিন-২৬শে মার্চ ১৯৭১। আমি
দেখেছি কি ভাবে বৈঠকখানার আড্ডা জমতে জমতে, হৃদয়ের ফূটন্ত
রক্ত ঘন হতে হতে বৈঠকখানার সম্মুখে লগির মাথায় ফুটে উঠে
লাল-সবুজের ফুল। সেই ফুলের সুবাস তৎক্ষণাৎ ছড়িয়ে পড়ে
চারিপাশ। কারও প্রান আরও উতলা হয় বৈঠকখানার ঘন আড্ডায়,
কারও দেহ মন অন্ধকারের পেছনে খুঁজে ষড়যন্ত্রের উৎকট গন্ধ।


বৈঠকখানায় জমতে থাকা স্বাধীকারের স্বপ্ন নিয়ে বাবা গেলেন
মুক্তি যুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হল, কিন্তু বৈঠকখানা স্বধীন হল না!
বাবার মৃত্যুতে কালো টাকার মাতাল করা গন্ধে “মানি ইজ নো প্রবলেম”
এর অসভ্য চেতনায় বৈঠকখানা হল ড্রয়িংরুম। কালো অন্ধকারের
পেছনের মানুষ অলক্ষ্যে গা ঢাকা দিল আরও গভীর অন্ধকারে,
দেখতে দেখতে ড্রয়িংরুমের ভারী পর্দায় আড়াল হল ঐতিহ্যের
বৈঠকখানা, এ যেন  আড়াল হল অথবা হচ্ছে লাল-সবুজের দেশ!