শুধু মনিপুর বা ভারতের নয়, প্রাচ্য থিয়েটারের জীবন্ত কিংবতন্তি রতন থিয়াম। আজ তা উপরে একটা লিখা পড়ছিলাম। তিনি এত আধুনিক এবং বাস্তব্বাদি মানুষ যে বলে বুঝানো যাবে না। তাঁর চিন্তা ধারার সাথে মিল রেখে এবং সেটাকে স্রদ্ধা রেখে বলতে চাই যে, আমাদেরকেও কবিতা লেখার ক্ষেত্রে কিছুটা বাস্তব্বাদি হতে হবে।
থিয়াম যেমন মনে করেন- আজকাল মানুষ আর ২/৩ ঘন্টাধরে নাটক বা সিনেমা দেখতে চায় না। এমনকি ১/২ ঘন্টার নাটক দেখতে গিয়েও পকেটে অনেকবার হাত ঢুকিয়ে অনুভব করতে চায় তার মোবাইল ফোনটা বাজচ্ছে কিনা। এতে মনস্তত্ব আলাদা হতে বাধ্য। ওই মনস্তত্বটাকে বুঝতে হবে, জানতে হবে এবং একে নিয়েই গবেষণা করতে হবে। এর জন্য টাইম ফ্যাক্টর, বিশ্বায়ন- এ সব বুজতে হবে। যেমন মার্বেল থেকে দালান কোঠার আর্কিটেকচারে কতটুকু পরিবর্তন  হোয়েছে, ডিজাইন, কালার, সাইজ এ সবে কতটা পরিবর্তন এসেছে তা ঘটা করেই বুঝতে হবে যদি কেউ সত্যকারেরনাটক করতে চায় কিংবা নাট্যকার হতে চায়।
আর ক’দিন পর আমাদের প্রথম আধুনিক কবি এবং আধুনিক কবিদের অন্যতম কবি আবুল হোসেনের প্রয়াত দিন। তারিখটা ২৯ জুন ২০১৪। এটা তাঁর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। গত বছর এই চির সবুজ আধুনিক কবি আমাদের ছেড়ে চলে যান পরপারে। তিনি জন্মেছিলেন ১৫ আগষ্ট ১৯২২ সালে। কবির সৌভাগ্য হয়েছিল কবি জীবনানন্দ থেকে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মত কবিদের সান্যিধ্যে এসেছিলেন। মজার ব্যাপার হল যে তিনি সে সময়েই এত শক্তিশালী ভিন্ন ধারার কবিদের মাঝে আধুনিক কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছিলেন যে সময়টায় এটা ছিল একটা চ্যালেঞ্জ।
এমন কি  বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও তাঁর কবিতার বিরুপ সমালোচনা করতে ছাড়েননি। তবে কবি আবুল হোসেন এই বিরুপ মন্তব্যকে বরং আশির্বাদ হিসেবেই দেখেছেন। আসলে বড় হতে গেলে সমালোচনাকে সুন্দর মন দিয়ে গ্রহন করার ক্ষমতা থাকতে হবে এবং তা না থাকলে শিখতে হবে। সে ক্ষমতা কবি আবুল হোসেনের ছিল বলেই তিনি আজ এতটা সমাদ্রিত এবং প্রশংসিত। তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ছিল ‘নববসন্ত’ (১৯৪০)। তারপর ‘দুঃসাহস’ (১৯৮২), ‘এখনও সময় আছে’ (১৯৯৭), ‘আর কিসের অপেক্ষা’ (২০০০) ইত্যদি। তিনি ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮০ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তাঁর লেখা কবিতা ছিল এমন যে ভাবতেই অবাক লাগে- এ সব বিষয় এবং সহজ কথাতে কবিতা হতে পারে। যেমনঃ  
আজকের দিনে রান্না ঘরের অন্দকারের মাঝে
যে মেয়েরা বসে চীনে বাসন মাজে
মশলা পিষতে চোখ ভরে আসে জলে
তাদেরও অন্ধ জীবনের তলে
উঁকিঝুঁকি মারে রাজকুমার। পেঁয়াজ কাটার ফাঁকে...
(বাংলার মেয়ে)


আবার কখনও তিনি লিখেছেন-


যখন বয়স ছিল দল বেঁধে তরুণ বন্ধুরা
আসতো মৌমাছির মত কখনও একাকী।
সেই এক ওড়ার সময় মাটিতে পা পড়ে না।
আর এখন যে যার বাজারে গেছে। পাংশু আঁশটে ঘরে
বাতি জ্বেলে বসে আছে যক্ষের মূর্তির মত একা একজন
নিঃশব্দ বিনিদ্র পাহারায়। অথবা বৌদ্ধের মূর্তি সে
নির্বান প্রার্থনায়, ক্ষুধা-তৃষ্ণাহীন। শব্দ নেই
ঘরময় কালের যাত্রার স্মৃতি গমগম করে।
(নিঃসঙ্গতা)


এ টুকু লেখার প্রয়াস এ জন্য যে আজকাল কবিতা লিখি কিন্তু কেউ কেউ এমন জ্ঞান দিতে চান যেন এ সব কোন কবিতাই না। ছন্দ এবং দাঁত ভাঙ্গা শব্দ আর একটু দুর্বোধ্য না হলে আবার কবিতা হল নাকি! রবীন্দ্র আর নজরুল এর ধারা ছাড়া কবিতা লেখা যেন সময়ের অপব্যাবহার। অথচ এই সময়ের সাথেই আজকের এমন কিংবতন্তি কবি লেখক,নাট্যকারগন যে ভাবে দর্শন দিচ্ছেন তাতে আর কেউ খুশি না হলেও হতে পারে কিন্তু আমার মত মূর্খ কবি খুবই খুশি এবং আনন্দিতি।


আরও মজার ব্যাপার হল যে, এঁরা যখন বলেন- কেউ যা লিখছে তাতে অর্থাৎ সে লেখায় সে কতটকু আনন্দ পাচ্ছে বা উপভোগ করছে সেটাই বড় কথা। এমন প্রশংসিত উৎসাহব্যাঞ্জক উপদেশ পেলে কবিতা লেখাটা যে ভেতর থেকেই বেরিয়ে যায়। সুতরাং মদ্দা কথা হল অশ্লীল নয়, সমাজ বিবর্জিত নয়, জীবনকে ছেড়ে নয়, কাউকে আঘাত দেয়ার জন্য নয় ( গঠন মূলক বিদ্রুপ সমাদ্রিত এবং সাহিত্যের অংশও বটে), ধংসের জন্য নয়, খুনের জন্য নয় কিংবা ক্ষতির জন্য নয়, এমন ‘নয়’ বিবর্জিত নান্দনিক লেখা কেন সাহিত্য হবে না তা আমার বোধগম্য নয়। তাই কে কি বলল তা নিয়ে যেমন আগের থেকেই আমি মাথা   ঘামাইনি বা আমার মাথাও ব্যাথা হতে দিইনি তেমনি সমালোচনাকেও গায়ে মাখিনি। আর এখন তো লাইসেন্স পেয়ে যাওয়ার মত এমন ছাড়পত পেয়ে আমি খুশি এবং বড্ড খুশি।


রতন থিয়াম আধুনিক নাট্যজগতে একজন জীবন্ত কিংবতন্তি, তাঁর জন্য রইল হাজারও সস্রদ্ধ সালাম। আর একজন কবি আবুল হোসেন সদ্য প্রয়াত, তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করি, তিনি যেন জান্নাত বাসি হোন।