শান্ত বাতাসে গো-চুনার গন্ধ না পেলে মনেই হয়না
আমি কোন গ্রামীন জনপদের বুক চিরে  প্রবেশ
করছি  আমার পুর্ব পুরুষের আদি ভিটায়। যেখানে
আমার নাড়ি পোঁতা কৈশর আজও খেলা করে নির্জন
দুপুরকে নিয়ে বরজের ছাদ ফুঁড়ে উঠা কোন যৌবনা
আম গাছের ঝোপ ডালে।  


দিবার প্রথম প্রহরে ডেকী মুরগির ডিম্বাণু উল্লাস।
ঘুম কাতুরে সকাল আর কর্মহীন ক্লান্ত সন্ধ্যায়
মোরগের খবরদারি হাঁক-ডাক, আঁজলা পুকুরে
হাঁসা-হাঁসিদের জলকেলি, ঘরের কার্নিশে ঝুলন্ত
ফোকরে কবুতরের মধুর গান আর হিরামন কবিতা
না শুনলে- মনেই হয় না নাড়ি পোঁতা সতিত্বের  
গ্রাম আমার এখনও বসবাস করে উদম বুকের মধ্যে।    


গেরস্থ চুলার পাড়ে পিঠা-পুলির আয়োজন,
কাঠ-খড়ির ঊষ্ণ ধোঁয়ায় চোখে জল, সেই
ধোঁয়ায় সান্ধ্যকালিন সুখি গ্রাম যেন ভাসে
হাজার পরীর শুভ্র পাখায় মেঘ হোয়ে, তার
ফাঁক গলে আকাশের তারা হোয়ে
মিটিমিটি জ্বলে সন্ধ্যা প্রদীপের আলো।


নতুন ধানের সোনালী গন্ধ, “ও ধান ভানিরে
ঢেঁকিতে পাড় দিয়া ঢেঁকি নাচে আমি নাচি
হেলিয়া দুলিয়া” এমন কোন গানের সুরে
ঢেঁকিতে পাড়ের শব্দ না শুনলে মনেই হয় না
আমি নবান্নের গ্রাম্য ঘুমে শরীরে জড়িয়েছি
ঠাকুর’মার স্বপ্নে বুনা অগ্রাহায়নের নক্সি কাঁথা।
আর ঘুমের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি চেনা দূর কোন
বংশীয় গ্রামে।  


ভূতুড়ে রাত কেমন দু'কান খাড়া করে থাকে
পিছন বাড়ির বাঁশ ঝাড়,  আর ছাতিম গাছের ঘন
পাতার ফাঁকে নিঃসঙ্গ হুতুম পেঁচা গা ছমছম করা  
ডাক ডাকে। কিছু ইঁদুর বারান্দার কোন ঘেঁষে ছুটে
যায় অন্ধকারে, পেছনে কাছাড়ি বিড়ালের দায়বদ্ধ
অনুসরণ যেন রাতকে করে জীবন্ত নাট্য মঞ্চ।


প্রত্যুষে রাখালি গামছা কাঁধে কাঁচা পথ ধরে দূর
মাঠের পানে হালের বলদ সাথে কৃষকের ব্যস্ত পায়ে  
চলা আর পান্তা মাথায় আটপৌড়ে কৃষানির চঞ্চলতা
না দেখলে মনেই হয় না আমি কখনও গ্রাম্য
এবং সরলতার আঁচলে দোল খাওয়া কোন নিঃস্পাপ
রমনীর সন্তান ছিলাম, যাঁর নিঃশ্বাসে ছিল বঙ্গীয় ধুম।


শিম ফুলের গোছায়  ছেটানো ছাই খোলা হাওয়ায় উড়িয়ে গান গায় কাজল ভ্রমর, দেখি প্রজাপতির চঞ্চলতা। ঘনছায়া ঘেরা শীতল মাচানের নীচে অলসে ঝুলে থাকা শশা, লাউ, কুমড়ার সাথে আনন্দের ঈষৎ ঢীসাঢিসি, নতুন আলু পোড়ার গন্ধ, বিলে শাপলা-শালুক আর পদ্ম ফলের স্বাদ এখনও মনের জিহ্বায় লেগে থাকে।


এমন অনেক গন্ধ খুঁজি, ছন্দ খুঁজি, স্বাদ খুঁজি। ঠিক খুঁজি
না বলে বরং সকাল, সন্ধ্যা, দুপুর রাত্রি ওরাই আমাকে
খুঁজে নেয় অথবা আমি জানতে আর অজান্তে ওদের মধ্যে
ডুবে থাকি সারাটাক্ষণ। কেননা আমি ভুলতে পারি না
আমার বাপ-দাদার ভিটেমাটি,  ভুলতে চাইলে দম আমার বন্ধ
হোয়ে আসে , নোনা জলে ঝাপসা হয় দু’চোখ, বুকের মধ্যে
পূর্বপুরুষের পরম্পরা গ্রাম আগলে রাখে তার ভীরু সতীত্ব।
আর গ্রাম আমায় হাত ছানি দিয়ে ডাকে বার বার।