এই- ক্ষনেই তো একটা ক্ষন পুরনো হয়ে যায়। মানে স্মৃতি হয়ে যায়। কিন্তু গভীর ভাবে মনে দাগ কাটা দুঃখের কিংবা সুখের স্মৃতি যেন পুরনো হতেই চায় না। গত ০৭ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখ পশ্চিম বাংলার সাহিত্য ও সংগ্রামের পূণ্য ভূমি কোলকাতার যাদবপুরে বিপ্লব তীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থা “শহীদ সূর্যসেন ভবন” এ  “ ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী কবিতা সম্মেলন- ২০১৯” যে ভাবে  অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তা যেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত মনে দাগ কেটে যাওয়ার মতই এখন এক গভীর সুখের স্মৃতি বহন করছে।  


১৯ শতকের গোঁড়া থেকেই হয়ত অথবা তার আগে থেকেই যাদবপুর ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার,   স্যার সিভি সুবোধ চন্দ্র, রাজা সুবোধ চন্দ্র মল্লিক ইত্যাদি প্রমূখ বরেন্য গুনি মানুষের পরিকল্পনা এবং উন্নয়নের ধারায় সমৃদ্ধ হচ্ছিল এই পূণ্য ভূমি যাদবপুর। সেখানে কৃষি বিজ্ঞান দিয়ে শুরু করে প্রকৌশল বিজ্ঞান থেকে আজ বিশ্বের দরবারে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সুশীল সমাজের মুখে মুখে। শ্বশুর বাড়ির  লোকেদের মুখে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের নাম শুনেছিলাম। তাদের অনেকেই সুদূর চট্টগ্রাম থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সেই বিগত ৫০শের দশকেই এখানে পা রেখেছিলেন। তো  সেই শিক্ষা আর সংস্কৃতির পূণ্য ভূমিতে আমিও এই একবিংশ শতাব্দিতে পা রাখতে পেরে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করছিলাম।
মাষ্টার দা সূর্যসেন এর জন্ম আমাদের চট্টগ্রামের রাউজানে অবস্থিত ছোট্ট সুন্দর সবুজে ঘেরা গ্রাম নোয়াপাড়ায়। জন্মঃ ২২ মার্চ, ১৮৯৪ আর স্বাধীকার আন্দোলনের নেতৃত্ব দানে বৃটিশ  উপনিশবাদীদের হাতে শহীদ হোনঃ ১২ জানুয়ারী, ১৯৩৪ সালে।


বাংলাদেশের কবিদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন শ্রদ্দেয় কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল। তিনি  গত ০৫ এপ্রিল, ২০১৯ এ আমার থেকে ঘন্টা তিনেক আগে গিয়েই  কবিতা সম্মেলনের প্রধান সমন্বয়কারী কবি ও বাচিক শিল্পী সৌমেন এবং বিশিষ্ট কবি ও শ্রুতি কাব্যের নায়ক কবি বিভূতি এবং আরও কয়েকজনের সাথে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সন্ধ্যার কিছু পূর্ব মুহূর্তে মুকুন্দুপুরে। বাধ সেধেছিল কাল বোশেখী ঝড়! এ ঝড়ও মনে হচ্ছিল কত  পরিচিত, কত আপন, যেন এ তো আমাদের ঝড়। চারণ কবি মুকুন্দু এঁর নামে মুকুন্দপুরে “অরুনোদয়” গেষ্ট হাউসে ছিল আমার থাকার ব্যবস্থা। আমার চিরকালের অভ্যেস কোন নতুন জায়গায় গেলে খুব ভোরে ঘুম ভেংগে  যাওয়া। আর ঘুম ভাংগা মানেই ভোর আর সকালকে দেখার জন্য হেঁটে চলা যত দূর পা আর শরীর চলে। পথে দেখি সে একই সড়ক, একই জঞ্জাল, একই ল্যান্ড স্কেপ। ভ্যানে করে শাক-স্বব্জীর বাজার দেখে দাম গুলোও জেনে নেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। লাউ কুমড়ো ৩০/৪০ রুপি বা ৪৫/৫৫ টাকা ঐ একই। সব ধরণের স্বব্জীর দাম প্রায় একই। কি করে বলি আমি আমার দেশে নেই!  


বাংলা কবিতা ডট কমের ব্যানারে এত দিনের ওপার বাংলার সদ্য বুলি ‘ভার্চ্যুয়াল’ কবি বন্ধুদের ডাকে ‘একচ্যুয়াল’ আবেগে ভাসার জন্য মন ছিল অস্থির। ০৭ এপ্রিল, ২০১৯ এ “ ভারত- বাংলাদেশ মৈত্রী কবিতা সম্মেলন- ২০১৯” এর দিন শহীদ সূর্য সেন হলের মঞ্চে পা রাখতে  রাখতে মঞ্চে রক্ষিত রোস্ট্রাম (Rostrum)  এ চোখ পড়তেই বুকটা ভরে উঠল। আমার একটুও মনে হল না আমি বাংলাদেশ তথা নিজ দেশের ম্যাগা শহর ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের বাইরে কোথাও সাহিত্য আড্ডায় যোগ দিতে এসেছি। সূর্যসেন তো আমার পরিবারের বীর যোদ্ধা, চট্টগ্রাম তো আমার আপন শহর। এ সব দেখলে কি করে মনে হবে আমি কোলকাতার যাদপুরে দাঁড়িয়ে আছি। সেই সো কল্ড ভার্চ্যুয়াল বন্ধুদের সাথে একচ্যুয়াল ভাবের বিনিময়ে বুকে জড়িয়ে ধরা, যে কত আপন অনুভূতি তা লিখে শেষ করা যাবে না। তার উপরে বাংলা কথা, কৃষ্টি, সাহিত্য সংস্কৃতি, হাসি, আড্ডা, পোষাক আশাক, খাওয়া দাওয়া সবই যেন মায়ের দেয়া পরম্পরা। কি করে ভাবি আমি আমার দেশে নেই!


কবি সৌমেন আগেই বলে রেখেছিলেন আমি যেন আমাদের জাতীয় সংগীতটা গাই। আমরা ০৫ জন মানে আমি, কবি অনিরুদ্ধ বুলবুল, একমাত্র মহিলা কবি আফরিনা নাজনীন মিমি, কবি চাঁছাছোলা ( সোহাগ আহমেদ) এবং কবি ফরিদ হাসানকে মঞ্চে এক সাথে পেলাম। আর ওপার বাংলার বন্ধুদের বলার আগেই দেখি সকলেই দাঁড়িয়ে গেলেন এক সাথে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি” সমবেত কন্ঠে আমাদের জাতীয় সংগীত গাওয়ার জন্য। সত্যি আমি খুব অভিভূত হয়েছিলাম। সে সাথে কবি অসিত কুমার  এর লিখা ও সুরে তার যোগ্য পুত্র অর্ক যখন দেশাত্ববোধের উপরে একটি গান গাইল তখন মনটা ভরে গিয়েছিল। কবির কাছে চেয়েছি সে গান। পাওয়ার অপেক্ষায়। একটু আধটু গাই বলে আমারও গান গাইতে ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু   কোলকাতার কোন সংস্কৃতিক সম্মেলন মঞ্চে হারমোনিয়াম তবলা-ডুগি নেই এটা আমার কাছে একটু হলেও অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।  


তবে বলার অপেক্ষাই রাখে না যখন আমাকে উত্তরীয় পরিয়ে এবং সাথে স্বর্ণ বর্ণের মেমেন্টো দিয়ে সম্মাননা দেয়া হল তখন চোখের কোনে জল, আনন্দ আর স্বীকৃতি পাওয়ার জল। কারন কবি বন্ধুদের সাথে দেখা করার জন্য ঢাকায় গত কয়েক সপ্তাহ বিভিন্ন দায়ীত্ব পালনের ফাঁকে ভিসা এবং টিকিট নিয়ে কোলকাতায় যেতে পারা না পারার যে দোলা চাল ছিল তা বর্ণনাতীত। আমার অতি আপন  জন বাংলা কবিতার পাতায় নব্য কবি লিজি আহমেদ বায়না ধরেছিল আমার সাথে যাবে। ভিসার জন্য তার পাসপোর্ট ছিল তখন কানাডিয়ান কর্তৃপক্ষের কব্জায়। তাই তার আর যাওয়া হয়নি। তবে তার লেখা প্রথম কাব্য গ্রন্থ “ পাঁচীলের ওপারেই সোনালী শহর” আর আমাকে নিয়ে লিখা ডায়েরী ঠিকই গিয়েছিল।  আর অন্যদিকে আশংকাও ছিল অফুরাণ। সব কিছুকে পিছনে ফেলে নিজেকে আবিস্কার করলাম আমি আমাদের বন্ধু মহলে বাস্তবেই কোলকাতার যাদবপুরে সূর্য সেন মঞ্চে দাঁড়িয়ে। এ ছিল এক চরম পাওয়া। সাথে কবি রিনা বিশ্বাসের হাতে যত্ন আর কত স্বপ্নে বানানো হ্যান্ডি ক্রাফটের ফুল আর ফুলদানী।  


আমি ভাল বক্তা নই। তবুও আমি আধুনিক কবিতা নিয়ে আমার বুঝাপড়া থেকে কিছু বলার চেষ্টা  করলাম। আমি যেমন শিখেছিলাম “ তোমার অক্ষি ‘পরে চাহিয়া দেখিলাম”, এখন আধুনিক কবিতায় এ ভাবে না লিখে সরাসরি লিখতে হয়ঃ “তোমার চোখের দিকে তাকালাম।“ এমন অনেক কিছু। এবার এই ‘তোমার চোখের দিকে তাকালাম’ এ নিয়ে কবিতাও একটা লিখে ফেলেছি কোলকাতা থেকে এসে। আমাদের এখানে সম্প্রতি নুসরাতের মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের গোটা জাতীকে নাড়া দিয়ে গেছে। কবি হিসেবে তাই ক্ষুদ্র প্রয়াস ছিল এটা। তা ছাড়া কে যেন লিখেও ছিল যে কবিদের মিলন মেলায় শুধু কবিতা আর গান নয় সমাজ ব্যবস্থায় কি দর্শন দেয়া যায় সে নিয়েও আলাপ আলোচনা হতে পারে কবিতার সাথে।
কবিতার মৃত্যু
-পলক রহমান।
তোমার চোখের দিকে যখনই তাকাই
দেখি ভোরের শিশিরের মত অথবা
শিউলি ফুলের মত সেখানে কবিতারা পড়ছে ঝরে।


কি করে যে চোখের জলের এক একটি ফোটা
কবিতা হয়ে যায়! যেমন কবিতা হয়ে যায়
একটি বিকেল, একটি নদী, একটি রাত, একটি ক্ষতি।


নীরবতাতেও তো অনেক গল্প কথা প্রেমময় আদর  
আর ভালোবাসার কবিতা থাকে। কিংবা থাকে
ঘৃণা, প্রতিবাদী শব্দ, অনাগ্রেহের ভাষা।


কিন্তু সব সময়, সব প্রতিক্রিয়ায় কি আর নীরব
থাকা যায়? তাইত নুসরাতরা লাশ হয়ে যায় মুহুর্তে।
অলক্ষ্যে মৃত্যু হয় একটি সোনালী স্বপ্নের, মৃত্য হয়
একটি নিরবদ্য কবিতার- জন্ম দিতে হাজার কবিতা!


১২ এপ্রিল, ২০১৯।


তবে একটা জিনিষ আমকে এত ভাল লেগেছে যে, কবিরা যে কাকের সহদোর এ দুর্নাম ঘুঁচে গিয়েছে বলে মনে হয়েছে। আসলেই কবিরা একত্রে বসলে সেখানে শৃংখলা বলে কিছু থাকে না। কিন্তু শত কবির এই মিলন মেলায় মঞ্চে, আসনে, খাওয়াদাওয়ায় প্রতিটি জায়গায় এত মগ্নতা, এত নীরবতা, এত যত্ন সভ্যতা আর শৃংখলা ছিল যে তা সকলের অনুসরনীয় হয়ে থাকবে। আমি এ কথা আমাদের বন্ধু মহলে বার বার এখনও বলছি এবং বলেই যাব। কারন কবিতার আড্ডায় যে এ গুলোরই প্রয়োজন সর্বাগ্রে।  


যা হোক, অনেক কথাই মনে আসছে। কোনটা রেখে যে কোনটা লিখতে পারছি বা লিখা উচিত  ছিল বা লিখতে চেয়েছিলাম এখন আর কিছুই মনে পড়ছে না। কবি বরুণ চক্রবর্তী,  কবি যাদব, কবি বিকাশ, কবি মল্লিকা, কবি মিতা চেটার্জী, কবি স্বপন, কবি পারমিতা, কবি আভা সরকার এমন অনেককে খুব মনে পড়ছে। তবে মিমি দিদি’কে তাঁর অনেক শারীরিক ব্যথা উপেক্ষা করে আমাদের কাছে আসায় দেখতে পেয়েছিলাম। উনাকে কাছে পেয়ে খুব ভাল লেগেছে। আর সৈকতের কথা কি বলব। অনেক আগে থেকেই আমার যাওয়ার ব্যাপারে  আমাকে উদবুদ্ধ করেই  গেছে। গিয়ে খুব ইচ্ছে ছিল কবি সামাকে দেখব, কবি রুমা চৌধুরীকে কাছে পাব। আর প্রয়াত কবি দেবাশীষের কথা  মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলব। এই কবিতা নিয়ে খেলা করতে গিয়ে এদের সাথে কত সখ্যতা ছিল। কিন্তু হল না।


অজিতেশ নাগের কথা কি আর বলব? অজিতেশ নাগ আর তার সহধর্মিনী সুমিতা নাগ অসাধারণ এক যুগোল। বৌদি আসার দিন আগের রাতে অনেক জায়গায় নিয়ে বেড়িয়েছে, খাইয়েছে, যত্ন  করেছে। তবে মোবাইল নিয়ে বাংলাদেশে তার সুখের  স্মৃতি যেমন আছে তেমনি  কাকতালীয় ভাবে মোবাইল নিয়ে তার সাথে আমারও একটা স্মৃতি জড়িয়ে গেল। পরে  রাঁধুনীতে গিয়ে পেলাম। মজার ব্যাপার হল বৌদির সাথে মোবাইল নিয়ে কি যে এক মজার সম্পর্ক আছে কে জানে! অজিতেশকে বলব এ নিয়ে কিছু লেখে যেন।


০৮ এপ্রিল, ২০১৯ যখন ঢাকা এয়ার পোর্টে এসে নামি তখনও আমার ঘোর কাটেনি। কি স্বপ্নের মত যে ক”টা দিন কাটিয়েছি তা স্মৃতিতে এখনও তাজা হয়ে আছে। সাথে সম্মেলন থেকে সকল প্রাপ্তি। সকলের নাম বলতে না পারা বা আলাদা করে লিখতে না পারা কবি বন্ধুদের অনেক যত্ন, আতিথেয়তা, সম্মান, ভালবাসা এখনও লালন করছি বুকের ভেতর। প্রতিদিন নেশার মত ফেবুর পাতা, ম্যাসেঞ্জারের পাতা আর প্রান প্রিয় বাংলা কবিতার পাতা উল্টিয়ে সকল বন্ধুদের খুঁজি।  জানি এ খোঁজাখুঁজি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আর বুঝি থামবে না। ভেতরে ভেতরে শুধুই বেজে যায় “ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়”। সকলের প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।