সৌমেন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবেশিত আজকের আলোচনা পাতায় 'কবিতা আবৃত্তির জন্য' এই বিষয়বস্তুটির রেশ টেনে আমার কিছু কথা এখানে প্রকাশ করার বাসনায় এটির অবতারণা করলাম। কারণ মন্তব্যের ঘরে লিখতে গেলে বিশাল বড়ো হয়ে যাবে। এ আসরে সৌমেন একজন অত্যন্ত দক্ষ আবৃত্তিকার ।  আর তারপরেই যার নাম করতে হয় তিনি হচ্ছেন মহিলা কবি সবার প্রিয় "মিমি"। এছাড়া অনেকেই আছেন যারা সুন্দর আবৃত্তি করেন এই আসরে।  


কবিতা রচনা যেমন একটি শিল্প, ঠিক একইভাবে আবৃত্তি একটা শিল্প। অনেক কবিতা পড়লেই আবৃত্তি করা যায়না। আবার একইভাবে আবৃত্তি শেখানো যায়না। কারণ এই শিল্পটি ক্লাসরুম প্রোডাক্ট নয়। আবৃত্তির প্রথম পাঠ আমি নিয়েছি অগ্রজ আবৃত্তিকারদের অনুসরণ করে তবে অবশ্যই অনুকরণ করে নয়। বারবার শুনি আর প্র্যাক্টিস করি কোনো অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করার আগে। যখন দেখি মোটামুটি নিজের প্রতি আস্থা এসেছে, তখন ডাকি আমার প্রথম শ্রোতা ও প্রধান শ্রোতা আমার স্ত্রী কে। আর কিছু না হোক ভুল উচ্চারণ গুলি সূক্ষতার সঙ্গে ধরিয়ে দেয়। সৌমেন এর তাই (৫) নাম্বার বিবৃতি টি এখানে উল্লেখ করলাম। শুদ্ধ উচ্চারণ--"কবিতা আবৃত্তির ক্ষেত্রে শুদ্ধ উচ্চারণই একজন বাচিক শিল্পীর নিকট থেকে আশা করেন সমজদার শ্রোতাগণ, তাই বলাবাহুল্য শব্দের উচ্চারণ যেন খুবই সাবলীল ও সঠিক মাত্রায় প্রকাশ পায় – সেদিকে আবৃত্তিকারকে নজর রাখতে হবে।"  সবার ওপরে  আন্তরিকতা ও অধ্যাবসায় ছাড়া কোনো কিছু অৰ্জন করা যায়না। আর সঙ্গে আবৃত্তির প্রতি ভালোবাসা তো থাকতেই হবে।


একটা উদাহরণ দিলে বোধয় বুঝতে সুবিধে হবে। একসময় অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে 'এইচ ম ভি'র'  'ফিয়েস্তা রেকর্ড প্লেয়ার' কিনলাম। আমার জীবনের প্রথম রেকর্ড কেনা দেবব্রত'র 'এ মনিহার আমার নাহি সাজে'। আর দ্বিতীয় রেকর্ডই ছিল কাজী সব্যসাচীর 'বিদ্রোহী'। যত বার শুনি ততই যেন অবাক হই । যেমন কণ্ঠস্বর, তেমন উচ্চারণ ও প্রকাশভঙ্গি, আর কন্ঠ নিয়ন্ত্রণ। তারপর অনেকের কণ্ঠেই এই আবৃত্তিটা শুনলাম। ভালো লাগে সবগুলোই, কিন্তু ওই যে একবার কাজী সব্যসাচীর স্টাইল টা হৃদয়ে গেথে গেলো, আর শত চেষ্টা করেও বার করতে পারলাম না। বিদ্রোহীর আমার সবচেয়ে প্রিয়  স্তবক  ষষ্ঠ স্তবক টি --" আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেনী, তন্বী নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি! ."


ঠিক তার আগের স্তবকে আছে
"আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কূর্ণিশ
আমি বজ্র, আমি ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শৃঙ্গার মহা-হুঙ্কার,


উঁচু দীপ্ত কণ্ঠ শুনে মনে হয় যেন বেদুইনদের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছেন , আর ঠিক পরের স্তবকে নিজের কণ্ঠ  কে ষোড়শীর হৃদি  বন্ধনহারা কুমারীর মতো নামিয়ে এনেছেন।আর এটাই আবৃত্তির সৌন্দর্য্য ও বিউটি।


এবারে সৌমেন এর প্রথম পয়েন্ট ....
"
(১) মুখস্থ
"যে কোন বিষয়ের কবিতা আবৃত্তি করার আগে কবিতার অর্থ বুঝে মুখস্থ করা খুবই জরুরী। দেখে পাঠ করা আর মুখস্থ বলার মধ্যে তফাৎ অনেক। মুখস্থ করে কবিতা আবৃত্তি করলে তার মেজাজই আলাদা  পাওয়া যায় এবং তাতে শ্রোতারাও মুগ্ধ হন অনেকাংশেই বেশি।"


লাখ কথার এক কথা বললে সৌমেন ভাই। যেটা তুমি বলোনি সেটা একটু সংযোজন করে দিই । আসলে হয় কি? কাগজ বা বই দেখে পড়লে সেটা কবিতা পাঠ হয়, ঠিক আবৃত্তি হয়না। শ্রোতাদের সঙ্গে দৃষ্টি সংযোগ(Eye Contact) না হলে আবৃত্তির সম্পূর্ণতা আসেনা।


অনেকে ভাবেন গলার স্বরটি জোরালো হলে, কণ্ঠস্বরটি ইচ্ছামতো ওঠানো-নামানো গেলেই ভাল আবৃত্তিকার হওয়া যায়। এসব গুণ থাকলে ভাল আবৃত্তি অবশ্যই করা যায়, তবে সবার আগে দরকার কবিতাটিকে ভাল করে নিজের ভিতরে ঢুকিয়ে নেওয়া।  কবিতার পালসটা ঠিক না ধরতে পারলে আবৃত্তি হয়তো করা যায় ,প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়না আর এটাই শিল্পীর কাজ।


উপসংহার :----
কবিতাকে ভালবাসা, কবিতা বারবার পড়া, একজন ভাল আবৃত্তিশিল্পী হওয়ার প্রাথমিক শর্ত। আবৃত্তি শিল্প অনেকটা দাঁড়িয়ে আছে ব্যক্তিগত মুনশিয়ানার ওপর। আপনি কোন সময়ে, কোন অনুষ্ঠানে, কী ধরনের কবিতা পড়বেন, আপনার বাছাই করা কবিতার সঙ্গে চারপাশে যা ঘটছে তার যোগ আছে কি না, আপনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে পারিপার্শ্বিক ঘটনাকে ছুঁতে চেষ্টা করবেন কি না,সেগুলো আপনাকেই ঠিক করতে হবে। যে মাইক্রোফোনটি আপনি ব্যবহার করছেন, তার ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়ালে আপনার গলাটি ঠিকমতো পৌঁছবে, সেটা আপনাকেই ভাবতে হবে। আপনি মঞ্চে কী ভাবে দাঁড়াবেন, দর্শকদের সামনে কী ভাবে  নিজেকে তুলে ধরবেন সেটাও আপনাকেই ভাবতে হবে। এমনকী আপনার সাজপোশাকও। আপনি নিজের টোটালিটিকে কী ভাবে উপস্থাপিত করবেন সেটা আপনাকেই খুঁজে নিতে হবে।যে খোঁজার হয়তো শেষ নেই। সেই খোঁজার গন্ধটা শুধু আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম।


সবশেষে কিছু টিপস .....
১ )জনপ্রিয় কবিতায় সীমাবদ্ধ থাকবেন না
২ ) শুধুমাত্র খ্যাতি বাড়ানোর জন্যে আবৃত্তি করবেন না ।
৩ )মাইক্রোফোনে জোরে আবৃত্তি করবেন না।


আমার কথা আজ এখানেই ফুরোলো ।


সবার শেষে প্রত্যেক পাঠকের জন্যে রইলো আমার অসীম শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা, কষ্ট করে আমার এই প্রবন্ধটি পড়ার জন্যে।
নবীন প্রজম্মের জন্যে রইলো আমার অকৃতিম ভালোবাসা ।