ছোটবেলার ছড়া গুলো আর আসে না রাজার কুমার পঙ্খীরাজে চড়ে ।  জীবনে ছোটবেলার দিনগুলো কতই না মধুর। ছোটবেলার স্বপ্ন থেকেই জীবনের স্বপ্নযাত্রা শুরু। মায়ের কোলে শিশু নিশ্চিন্তে ঘুমায়। মা এর স্নেহের সুরে ছোটবেলার ছড়া গুলো শুনতে শুনতে শিশু র মন কে নিয়ে যায় কোনো এক কল্পনার জগতে। ছড়া গুলো শুনতে শুনতেই শিশুর মুখে ফুটে ওঠে বুলি। আর এভাবেই ক্রমশ সে এগিয়ে যায় আর পৌঁছে যায়  যৌবন তারুণ্যে। অরূপের অন্ধকার থেকে প্রথমে আলোর বিন্দু এসে ঝরে পড়ে রূপের জগতে। সে আলোয় শিশুর প্রথম আবির্ভাবেই চেতনার জন্ম হয়। ছড়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বলে, মাগো মা আমি এলাম তোমার কোলে।সেই অধ্যায়ে রয়ে যায় কতই না স্মৃতি। সেই স্মৃতি যেন ব্যক্তি জীবনের পাতায়  আবির মেখে রং ছড়ায়। বিবর্ণ হতে দেয় না স্মৃতির মণিকোঠা।


একবিংশ শতকে সেই  ছেলেবেলার ছড়া গুলো ক্রমশ বোধয় লুপ্ত হতে চলেছে। বর্তমান প্রজন্মে যেসব শিশু ভূমিষ্ট হচ্ছে , তারা কি আর মায়ের মুখে এই ছড়াগুলো কি আর শুনতে পাবেনা ? আমাদের জীবন শুরু হয় মায়ের ঘুম পাড়ানি ছড়া দিয়ে। আর সেই মিষ্টি ছড়াগুলো যেন আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে যায় মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। লং টার্ম মেমোরিতে সেই কবেকার ছড়াগুলো এখনো গড়গড় করে বলতে পারি। আর এখন তো অনেক ভালো ভালো ছড়া লেখা হয় , শর্ট টার্ম মেমরি তে তা ধরে রাখতে পারিনা কেন? লেখকের নাম না জানা ছেলেভুলানো ছড়াগুলো হৃদয়ে এখনো দোলা দেয়।


একটা সময় ছিল ছড়ার মাধ্যমে একসময়ে সহজ উপায়ে বাচ্চাদের ইংরেজি শব্দ শেখানো হতো।


"গড্ ঈশ্বর লর্ড ঈশ্বর কম মানে এস
ফাদার বাপ্ ,মাদার মা .সিট্ মানে বস।
ব্রাদার ভাই ,সিস্টার বোন , ফাদার সিস্টার পিসি ,
ফাদার-ইন-ল মানে শ্বশুর, মাদার সিস্টার মাসি।
আই মানে আমি আর ইউ মানে তুমি ,
আস মানে আমাদিগের , গ্রাউন্ড মানে জমি।
ডে মানে দিন আর নাইট মানে রাত .
উইক মানে সপ্তাহ ,রাইস মানে ভাত।
পম- কিম লাউকুমড়া কোকোম্বার শশা .
ব্রিনজেল বেগুন আর প্লোম্যান চাষা।


এই ইংরেজি শব্দগুলো সহজে শিখে যেত শিশুরা। অতীতে বাঙালি শিশুর অঙ্ক কষা, হিসাব শেখানো সবই হতো মুখে মুখে ছন্দে বা পয়ারে। এদের বলা হত আর্যা। এই আর্যাগুলোকেই বলা হয় ছড়ার আদি রূপ।  


ঘুমপাড়ানী মাসি পিসি,
মোদের বাড়ি এসো।        
খাট নাই পালং নাই,      
চোখ পেতে বোসো।        


বাটা ভরা পান দেব,      
গাল ভরে খেও।            
খোকার চোখে ঘুম নাই,    
ঘুম দিয়ে যেও।


এমন ছড়া গানের চিরায়ত কথাগুলো মায়েদের মুখে মুখে ফিরত একসময়ে। অনেক কথাই পালটে ফেলতে হবে আজ এই ছড়া নতুন করে লিখতে গেলে।  আজ খাট-পালংয়ের অভাব না হলেও দিন দিন ছোট হয়ে আসা একক পরিবারে ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসিরাই বিরল। কিন্তু শিশুকে সময়মতো ঘুম পাড়াতে হবে। কেননা শিশুর জন্য ঘুম খুবই জরুরি। তাই এখনকার মায়েদের এই মিষ্টি মধুর ছড়াগুলো না জানার ফলে মোবাইলে
youtube চ্যানেলে গিয়ে হিন্দি কিংবা বাংলা আধুনিক গানের আশ্রয় নিতে হয়।


ছড়ার মাধ্যমে শেখা শিশুদের নির্দিষ্ট ধারণা আরও ভালভাবে মিলিত হতে সহায়তা করে। শিশুদের কবিতা অভিব্যক্তিগত ক্ষমতাও বিকাশ করে।
মায়েদের কাছে ক্রমাগত শুনতে শুনতে পিতা মাতার অজান্তেই শিশুর মগজে গড়ে ওঠে এক কবিতার পাঠশালা। মানুষের দ্রুততম বিকাশ হয় শৈশবের শুরুতে।  জন্মের পর থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত থাকে বিকাশের এই পর্ব।ছয় মাসের মধ্যেই মানুষের মস্তিষ্কের অর্ধেক গঠিত হয়ে যায় এবং আট বছরের মধ্যে তৈরি হয় ৯০ শতাংশ। শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি, আবেগ, সামাজিক যোগাযোগ ও শারীরিক সম্ভাবনা বিকাশের জন্য ছড়া কবিতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমার ধারণা। বাংলার গ্রামে গঞ্জে  শিশুর যত্ন ও প্রতিপালন বিষয়ে মা-বাবাদের জ্ঞান ও সচেতনতা খবুই সীমিত। ছোট শিশুর বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো অধিকাংশই জানে না। সেক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে মায়েদের মুখ থেকে শোনা ছড়াগুলো জীবনের শুরুর দিকে উৎসাহ যোগানো ও বিকাশে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। কথা বলা, পড়া, গান গাওয়া, ধাঁধাঁর সমাধান এবং অন্যদের সঙ্গে খেলাধুলা শিশুর ওপর সুস্পষ্ট প্রভাব ফেলে।


পৃথিবীর আলোয় যখন আসে আমাদের শিশুটি তার জন্যে আমরা সবাই চেষ্টা করি তার জন্যে একটি সাজানো বাগান গড়ে দিতে। আর সেই বাগানের প্রথম বীজটি আমরা রোপণ করি মায়ের মুখ থেকে শোনা কবিতা দিয়ে।  মা-বাবার ঘরটাই 'সুকান্তের সেই বাসযোগ্য পৃথিবী।'  শিশুটিকে আমরা যদি বড় করে তুলি আপন মমতায়, সঠিক বিকাশে  তাহলে সে হয়তো তার পৃথিবীটাকে তার মতো করেই বাসযোগ্য করে তুলবে। মনের মতো সাজাবে আপন পৃথিবীর বাগানটাকে আর কবিতার বাগানটিকে।  


শিশু ছড়া এভাবেই  শিশু মনকে বিকশিত করে।