বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার পল্লীকবি 'জসীম উদ্ দীন' এর অনবদ্য সাড়া জাগানো অসাধারণ সৃষ্টি 'নকশি কাঁথার মাঠ'।
জন্ম : ১ জানুয়ারী ১৯০৩
মৃত্যু : ১৩ ই মার্চ ১৯৭৬


কোনো শব্দের ব্যবহারেই এই অনন্য কবিতার মন্তব্য করা চলেনা। অসাধারণ, অসামান্য ,রোমান্টিক এই আখ্যানকাব্য টি মোট ১৪টি অংশে লেখা। প্রথম প্রকাশ ১৯২৯খৃষ্টাব্দে। অর্থাৎ কবির বয়স তখন ঠিক ২৬। এই বয়েসে এই দুর্ধষ্য কবিতা? ভাবলে মনে জাগে শিহরণ। এটি এমন একটি কবিতা যে একবার শুরু করলে সবকটা ১৪ টি অংশ না পড়ে ওঠা যায়না।  এটি জসীমউদদীনের একটি অমর সৃষ্টি হিসাবে বিবেচিত। কাব্যগ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদিত হয়ে বিশ্বপাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল।  নকশী কাঁথার মাঠ কাব্যোপন্যাসটি রূপাই ও সাজু নামক দুই গ্রামীণ যুবক-যুবতীর অবিনশ্বর প্রেমের করুণ কাহিনী। এই দুজনই ছিলেন বাস্তব চরিত্র।জসীমউদ্দীন চরিত্রটি রূপায়ণ করেছিলেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার শিলাসী গ্রামে রূপাই নামক এক অত্যন্ত বলবীর লাঠিয়াল কে নিয়ে। কাব্যে, রূপাইয়ের বিপরীতে 'সাজু' নামক যে নারী চরিত্রের উল্লেখ করেছেন তার নাম ছিল 'ললীতা'।  রূপা ললীতাকে ভালোবাসতেন। ললীতা ছিলেন রূপার প্রতিবেশী গ্রাম মশাখালী'র বাসিন্দা।
গফরগাঁও বাজারের কাইয়ুম মার্কেটে একটি স্টলে আড্ডা দিতেন জসীমউদ্দীন।  সেখানে বসেই রূপাই সম্পর্কে খোঁজখবর নেন তিনি৷ সেই স্টলেই কবির সঙ্গে রূপার পরিচয় হয় এবং রূপা তাঁর নিজের সম্পর্কে জানান জসীমউদ্দীনকে। কাব্যের রুপাই বাস্তবের রূপাইয়ের মতোই বলবান বীর ছিলেন, ছিলেন সেরা লাঠিয়াল। কবির অন্যতম সঙ্গী ছিলেন খ্যাতনামা সাহিত্যিক মৌলভী শেখ আবদুল জব্বার। বনগাঁও গ্রামে একবার তাঁর বাড়িতে  অবস্থানকালে গ্রামে জমির ধান কাটা নিয়ে একদিন বড় ধরণের এক দাঙ্গা  হয়৷ সেই দাঙ্গায় গফরগাঁওয়ের লাঠিয়াল দলের নেতৃত্ব দেন শিলাসী গ্রামের কৃষ্ণবর্ণের হালকা-পাতলা ছোটখাটো গড়নের যুবক রূপা৷ পল্লীকবি সেই দাঙ্গা দেখেন। দেখেন গ্রামাঞ্চলে জমি দখলের এক নারকীয় দৃশ্য৷ লাঠিয়াল দলের নেতৃত্বদানকারী রূপার তেজোদীপ্ত এক ভয়ঙ্কর বীরত্ব৷ ওই দাঙ্গাই কবির মনে রেখাপাত করে৷ আর তাঁর থেকে সৃষ্টি হলো নকশী কাঁথার মাঠ৷ রুপা খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতো। এই বাঁশি শুনেই পাশের গ্রামের মেয়ে সাজু রুপার প্রেমে পড়ে।  ভালোবাসা হয়, আর তারপর হয় বিয়ে।পাতলো তারা দুজনে মিলে সুখের সংসার। একদিন গভীর রাতে চাঁদ ওঠে, গোবর নিকানো আঙিনায় মাদুর পেতে সাজু রূপাইয়ের কোলে শুয়ে একমনে রুপাইয়ের বাঁশি শুনছিলো। হটাৎ এক অজানা কারণে বাঁশির সুর গেলো থেমে। সে ভাবে, এত সুখ আমার সইবে তো!? এক অজানা আশঙ্কায় তার অন্তরের বেদনাশ্রু সাজুর কোমল মুখের ওপর পড়ে। রুপাই  এর চোখে জলের ধারা দেখে সাজু বলে, তুমি কাঁদছ কেন? তোমাকে তো আমি কোনো আঘাত দিইনি। রূপাই বলে, এক অজানা আশঙ্কায় কাঁদছি। এমন সময় হঠাৎ খবর আসে, বনগেঁয়োরা তাদের গাজনা-চরের পাকা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে। রূপাই ছুটে যায় লড়কি-সড়কি হাতে বনগেঁয়োদের প্রতিরোধ করতে। কয়েকটি খুন হয় এবং ফলশ্রুতিতে রূপাই ফেরারি হয়ে যায়। আর সাজু রোজ একটা পিদিম বা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে থাকে রূপাইয়ের পথ চেয়ে।  এভাবেই তাঁর দিন চলে যায়। একদিন গভীর রাতে রূপাই এসে দাঁড়ায় সাজুর সামনে। সাজু দেখে, রূপাইয়ের সারা গায়ে মাটি মাখা, রক্তের দাগও লেগে আছে কোথাও কোথাও। সাজু তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তোমাকে আর যেতে দেবো না।’ রূপাই বলেছে, ‘আমার না যেয়ে উপায় নেই, যেতেই হবে। কেননা, আমি যদি ধরা পড়ি, আমার ফাঁসি অথবা কালাপানি হবে।’ সাজু এখানে বলেছিল, ‘তুমি তো চলে যাবে আমাকে কার কাছে তুমি রেখে যাবে’, তখন রূপাই বলে,


'সখী দীন দুঃখীর যারে ছাড়া কেহ নাই
সেই আল্লার হাতে আজি আমি তোমারে সঁপিয়া যাই।'


ইহলোকে রূপাইয়ের সঙ্গে সাজুর এই ছিল শেষ দেখা।জন্মের মতো চলে গেল রুপাই। এসব অতীত স্মৃতি কাঁথার ওপর ফুটিয়ে তুলতে লাগলো সুচ -সুতো  দিয়ে সুজা। যেদিন সেই কাঁথা বোনা শেষ হয়ে গেলো, সাজু তার মায়ের কাছে দিয়ে বললো, ‘মা, আমার মরণের পরে যেখানে কবর দেওয়া হবে, সেই কবরের ওপরে যেন এই নকশী কাঁথাখানা বিছিয়ে দেওয়া হয়। আর যদি কোনোদিন রূপাই এসে আমার খোঁজ করে, তাকে বোলো, তোমার আশায় সাজু ওই কবরের নিচে আছে।’
বহুদিন পরে গাঁয়ের কৃষকেরা গভীর রাতে বেদনার্ত এক বাঁশির সুর শুনতে পায়, আর ভোরে সবাই এসে দেখে, সাজুর কবরের পাশে এক ভিনদেশি লোক মরে পড়ে আছে। কবি জসীমউদ্দীন এই আখ্যানের একেবারে শেষ পর্বে এর করুণ বেদনাকে প্রকাশ করতে লিখেছেন:


আজো এই গাঁও অঝোরে চাহিয়া ওই গাঁওটির পানে
নীরবে বসিয়া কোন্ কথা যেন কহিতেছে কানে কানে।


উপসংহার :-


এই একটি কবিতাকে নিয়ে তৈরী হয়েছে টেলিফিল্ম,পরিবেশিত হয়েছে নৃত্যনাট্য। ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান নকশী কাঁথার মাঠ নৃত্যনাট্যের সঙ্গীত পরিচালনা করে ইরান, ইরাক, এবং পাকিস্তানও সফর করেন। আমার অন্তত জানা নেই যে শুধু কোন বিশেষ একটি কবিতাকে নিয়ে এতো আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। এমনকি রবীন্দ্রনাথ অথবা নজরুলের কোনো একটি বিশেষ কবিতা নিয়ে কোনো টেলিফিল্ম বা নৃত্যনাট্য হয়নি। আজ ও অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে 'নকশি কাঁথার মাঠ' পরিবেশিত হয়ে থাকে এবং যা অত্যন্ত জনপ্রিয়।


আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার লেখার ইতি টানলাম ।


নিচের ছবিতে ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে জসীম উদ্দীনের কবরস্থান দেখানো হয়েছে।