এই নিবন্ধটি লেখার প্রধান উদ্দেশ্য হলো নতুন প্রজন্ম জানুক যে কি ঘটেছিলো এই পবিত্র দিনটিতে। যত দিন যাবে, যত  শিক্ষার বিস্তার হবে, যখন আরো বেশি করে বর্তমান প্রজন্ম এই মহামানব কে জানবে, তাঁর ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হবে , তখন তারা যেন উপলব্ধি করতে পারে, যে মহান বাঙালি মহিষীকে জানবার জন্যে গোটা বিশ্ব একদিন ব্যগ্র ছিল, দেশ বিদেশে যিনি রাজা মহারাজার চেয়েও বেশি সম্মান পেয়েছেন, যাঁর সান্নিধ্যে এলে জগতের মহারথীরা কৃতার্থ হতো, সেই আমাদের প্রাণের কবিগুরুকে তাঁর মৃত্যুদিনে বাঙালি জাতি তাদের চরিত্রের বিশৃঙ্খলা ও অশোভন আচরণের চূড়ান্ত নিদর্শন দেখিয়েছিলো। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এতো সহায় সম্পদ ও জনবল থাকা সত্ত্বেও অব্যবস্থার সীমা ছিলোনা। তাঁকে শেষ দেখা দেখার জন্যে যখন দেশবাসী উত্তাল ও উৎসুক, কেন তাকে ঘন্টা বারোর জন্যে lying in state এর বন্দোবস্ত করা হলোনা? পুত্র রথীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তার শেষক্রিয়া ঠিকমতো করতে পারেন নি। পরিস্থিতিকে সামাল দেবার জন্যে একমাত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এগিয়ে এসেছিলেন। আজ বাঙালি হিসেবে এসব ভাবলে লজ্জায় মাথা হেট্ হয়ে যায়। তার সেই পরম মূল্যবান নোবেল প্রাইজ টি পর্যন্ত আমরা রক্ষা করতে পারিনি। আজ ভাবতে  লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে যায় যে সেই কত পরিশ্রমের দ্বারা সংগৃহিত নোবেল পুরস্কারটি আমরা রক্ষা পর্যন্ত করতে পারলাম না! এতো অক্ষম আর অকৃতজ্ঞ আমরা হতে পারলাম? যা ভোলার নয়, যা মনে করলে জীবন সার্থক হয়ে যায় সেটি এমন অবহেলায় আমরা হারিয়ে ফেললাম সারাজীবনের মতো? ২৫শে মার্চ ২০০৪, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ১৫মিনিট। আর দশটা দিনের মত কর্মচাঞ্চল্যে মেতে উঠেছে শান্তিনিকেতন। যথারীতি ক্লাশ করেছে বিশ্ব ভারতীর ছাত্ররা। হঠাৎ বিনা মেঘে ব্জ্রপাতের মত খবরটা ছড়িয়ে পড়ল নোবেল চুরি হয়েছে। সবাই ছুটল রবীন্দ্রনাথের বাড়ী উত্তারায়নের দিকে।আজ এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলো সেই অতি মুল্যবান বাঙালির ধন আর খুঁজে পাওয়া গেলোনা!


আবার ফিরে আসি সেই বাইশে শ্রাবণের কলঙ্কময় দিনটিতে।  


"মৃত্যু যেদিন বলবে, "জাগো প্রভাত হলো তোমার রাতি'
নিবিয়ে যাবো আমার ঘরের চন্দ্র সূর্য দুটো বাতি
আমরা দোঁহে ঘেঁসাঘেঁষি,
চিরকালের প্রতিবেশী
বন্ধুভাবে কণ্ঠে সে মোর জড়ায়ে দেবে বাহুপাশ
বিদায়কালে অদৃষ্টেরে করে যাবো পরিহাস।


সেই বিদায়কালের পরিহাস ই জুটলো কবিগুরুর কপালে? মৃত্যু যখন দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে ,ঠিক তার চারদিন আগে কবিতা রচনা করলেন মুখে মুখে। .
"দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে,
মৃত্যুর নিপুন শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে"


ওপরের কবিতাটি লেখার তারিখ ঊনত্রিশে জুলাই ,১৯৪১ সাল। তার ঠিক একদিন আগে কবিকে আনা হয়েছে শান্তিনিকেতন থেকে জোড়াসাঁকোতে।    


অপারেশন টেবিলে ওঠানো হলো কবিকে। তারিখ টি ছিল তিরিশে জুলাই। তাঁর চেতন মস্তিষ্কে শেষ পুরস্কারটি আমাদের দিয়ে গেলেন মুমূর্ষু  রবীন্দ্রনাথ।খুব সম্ভবত পাশে থাকা রানী চন্দ্র লিখে নিয়েছিলেন কবিতাটি। নাহলে আমরা বঞ্চিত হতাম তাঁর শেষ কবিতা থেকে।
".কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে।
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।।"


অপারেশন টেবিলে উঠে কবিতা রচনা ?  কল্পনা করা যায় ?


কবিকে নিয়ে Power Politics?


কবিকে নিয়ে জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতনের মধ্যে একটা Power Politics অনেকদিন ধরেই চলছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁদেরই আপন জন, এটা প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিল দু'পক্ষই। কবির শেষ বয়সে এই দ্বন্দ্ব তিক্ত আকার ধারণ করে। মৃত্যুলগ্নে এসে তা রীতিমতো লড়াইয়ে পরিণত হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজে ঝুঁকে ছিলেন শান্তিনিকেতনের দিকে। একেবারে গোড়া থেকেই নাগরিক জীবনের শুকনো প্যাঁচপয়জারে তাঁর বিতৃষ্ণা ছিল। ঠাকুর-পরিবারের কাছ থেকেও নানা আঘাত পেয়ে মনটা তেতো হয়ে উঠেছিল তাঁর। আশ্রমেই ছিল তাঁর প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি। শেষ ক্রিয়াকর্ম যেন তাঁর সাধনক্ষেত্র শান্তিনিকেতনেই হয়, উদার প্রকৃতির কোলে- এমনই সাধ ছিল তাঁর। কিন্তু, ভাগ্যের পরিহাস- আধুনিক চিকিত্‍সার দায়ে তাঁকে শেষ আশ্রয় নিতে হল সেই কলকাতাতেই, শেষ শ্বাসটিও রেখে যেতে হল ক্লিন্ন নাগরিক বাতাসেই।একরকম জেদ-জবরদস্তি করেই কলকাতা-শিবিরের লোকজন আশ্রম-শিবিরকে হঠিয়ে দিয়ে, তাঁদের বক্তব্যকে পাত্তা না দিয়ে, এমনকী কবির ইচ্ছার মর্যাদাও না রেখে- মৃতদেহ দখল করেছেন এবং সম্পূর্ণ নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতায় শবযাত্রা ও দাহকর্ম সংঘটিত করে দিয়েছেন।


বহু-ধিক্কৃত সে সব কাহিনি। বুদ্ধদেব বসু তো উপন্যাসেও অমর করে রেখেছেন সেই শ্রাবণদিনের হাহাকার। নির্মলকুমারী মহলানবীশের বিখ্যাত স্মৃতিকথায়, অমিতা ঠাকুর ও আরও কয়েকজনের বয়ানে বিস্তর মর্মান্তিক মুহূর্ত লিপিবদ্ধ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক হল শব-দর্শনার্থী জনতার উন্মত্ত নির্লজ্জতা- কবির মৃতদেহ স্নান করানোর নিভৃত মুহূর্তটিতে রুদ্ধদ্বার ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়া।  বিশৃঙ্খল জনতা লোহার গেট ভেঙে উঠে এসেছিল দোতলার বারান্দায়, তাঁর শেষ শয্যার অনতিদূরে। এমনকি কবির মৃতদেহ থেকে চুল ও দাড়ি ছিঁড়ে নেওয়ার ঘটনা শোনা যায়। শবের পাশে বসে নন্দলাল বসু নাকি পাখার বাঁট দিয়ে সেই 'স্মারক'-লুব্ধ ভক্তদের তাড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন।


শ্মশানের ছবিটি ছিল ভয়াবহ। এমন একজন অসামান্য ব্যক্তির দেহ কীভাবে সম্মানজনক ভাবে সত্‍কার করতে হয়, শ্মশান বা কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ কেউই তার জন্য প্রস্তুতি রাখেননি। একটা বেড়া পর্যন্ত ছিল না মৃতদেহের সুরক্ষার জন্য। কর্দমাক্ত প্রায়ান্ধকার শ্মশানে কবির দেহ শুইয়ে রাখা হয়, এবং উচ্ছৃঙ্খল লোকজনের হাতে লাঞ্ছিত হয় নানাভাবে। চুল-দাড়ি ছেঁড়া তো ছিলই, পদদলিত হওয়ার অভিযোগ- বা চিতা নির্বাপনের সময় অর্ধদগ্ধ অস্থি সংগ্রহের জন্য জনতা পাগল হয়ে উঠেছিল বলেও উল্লেখ আছে।


যে কথাটি অনেকেই শুনলে চমকে ওঠেন আজও তা হল- কবির শেষ সত্‍কারটুকুও তাঁর একমাত্র পুত্রের হাতে হয়ে উঠতে পারেনি। ছেলের হাতের আগুন পাননি রবীন্দ্রনাথ। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্মশানে পৌঁছতেই পারেননি, কেউ কেউ জল্পনা করেন তাঁকে ইচ্ছা করেই আটকে দেওয়া হয় মাঝরাস্তায়। শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথ।


উপসংহার:-
যে-কবির কল্পনায় 'শান্তিপারাবারে'র ছবি আঁকা ছিল, উশৃঙ্খল বাঙালি জাতি তাঁর প্রয়াণের কালে এই কথাগুলো এক স্থায়ী কলঙ্ক হয়ে রয়ে গিয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে।