কবিতার অনুবাদ যদি শুধু ভাষান্তরিত হয় তাহলে শুধুমাত্র অনুবাদ হয় কবিতা হয়না।নিষ্প্রাণ অনুবাদের কাব্যগুণ আদৌ পৌঁছাবে না পাঠকের কাছে। অনুবাদের সমস্যা হলো অনুবাদক যে  কবির কবিতা অনুবাদ করবে তাঁর সমগ্র সাহিত্যের অভিমুখ, বিচরণ ক্ষেত্র, এবং জীবনদর্শন সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া যে ভাষায় মূল কবিতাটি লেখা হয়েছে সেই ভাষাটি যে অঞ্চলের সেখানকার  জীবনধারা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধেও কিছুটা ওয়াকিবহাল হওয়াটাও খুব দরকারি। নইলে হয়  ভাষান্তরিত কবিতাটির ভাব মূল কবিতার ভাব থেকে অনেক দূরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাবে, অথবা সেটির আক্ষরিক অনুবাদের আড়ষ্টতায় আবদ্ধ থেকে, সেটি প্রকৃত কবিতা হয়ে উঠবে না।  একই কাব্য বিভিন্ন মনে বিভিন্ন তাৎপর্য পায়।  তাছাড়া অনুবাদক কোন ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন- ভাব, কবির নিজস্বতা ইত্যাদি- সেটার প্রভাব তো আছেই। বিশ শতকের ইংরেজি সাহিত্যে আধুনিক কাব্য আন্দোলনের অন্যতম কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস। আধুনিকতার প্রাণ পুরুষ এই কবির কাছে আমাদের বাংলা সাহিত্যেরও আছে বেশ খানিকটা ঋণ। রবীন্দ্রনাথকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, লিখেছেন গীতাঞ্জলীর ভূমিকা।  কবিতার অনুবাদের মত বিড়ম্বনা আর নেই।  অনুবাদকের জন্যে, একই সাথে কবির জন্যেও।
রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম
ইরানের জীবনবাদী কবি ওমর খৈয়ামের রুবাই বা কবিতা অবলম্বনে 'রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম' এর অনুবাদগ্রন্থ রচনা করেন নজরুল। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এ অনুবাদে অত্যন্ত চমৎকার ভাষাভঙ্গি ব্যবহৃত হয়েছে।রোমান্টিক মনোভাব এবং দার্শনিক মনোভাব মিলে ওমর খৈয়ামের চতুষ্পদী কবিতাগুলো অপূর্ব ক্যাব্যিক রসে পরিপূর্ণ করে তুলেছে।  
"শরাব আনো ! বক্ষে আমার খুশির তুফান দেয় দোলা ।
স্বপ্ন-চপল ভাগ্যলক্ষী জাগল জাগ ঘুম-বিভোল !
মোদের শুভদিন চলে যায় পারদ-সম ব্যস্ত পা’য়,
যৌবনের এই বহ্নি নিভে খোজে নদীর শীতল কোল ।"


রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম-এর ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন: ‘আমি ওমরের রুবাইয়াৎ বলে প্রচলিত প্রায় এক হাজার রুবাই থেকেই কিঞ্চিতোধিক দুশ’ রুবাই বেছে নিয়েছি এবং তা ফারসি ভাষার রুবাইয়াৎ থেকে। কারণ, আমার বিবেচনায় এইগুলি ছাড়া বাকি রুবাই ওমরের প্রকাশভঙ্গি বা স্টাইলের সঙ্গে একেবারে মিশ খায় না। আমি আমার ওস্তাদি দেখাতে গিয়ে ওমর খৈয়ামের ভাব বা স্টাইলকে বিকৃত করিনি, অবশ্য আমার সাধ্যমতো।…ওমরের রুবাইয়াতের সবচেয়ে বড় জিনিস ওর প্রকাশের ভঙ্গি বা ঢং। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি ওমরের সেই ঢঙটির মর্যাদা রাখতে, তার প্রকাশভঙ্গি যতটা পারি কায়দায় আনতে।


আমার মূল বক্তব্য :-
আসলে কাজী নজরুল যেহেতু ফার্সি ভাষা জানতেন, তাই তিনি সরাসরি মূল ভাষা থেকে অনুবাদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং তার জন্যে তাঁর অনুবাদগুলি অনেক বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে । বাকি যারা ওমরের রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেছেন তারা ফিটজারল্যান্ডের ইংরেজি অনুবাদ থেকে অনুবাদ করায় ততটা প্রাণ পায়নি।তাই সার্থক ভাবানুবাদ করতে গেলে যে মূল ভাষা থেকে অনুবাদক অনুবাদ করছেন সেটার অনুবাদ অনেক প্রাণ পায় বেশি।
ভুপেন হাজারিকার বিখ্যাত গান ‘আমি এক যাযাবর’ গানটি অনুবাদ করতে গিয়ে যাযাবর শব্দের সঠিক অনুবাদ করতে গিয়ে মুস্কিলে পড়েছিলেন গুলজার। কারণ আক্ষরিক অনুবাদের  যাযাবরের প্রতিশব্দ হতে পারত – মুসাফির বা বনজারা। কিন্তু এই গানটির সঙ্গে যেহেতু গুলজারের সম্যক পরিচয় ছিল, তিনি মনে করেছিলেন মুসাফির বা বনজারা কোনোটাই এই গানের মেজাজের মর্মে পৌঁছাতে পারছিল না । তাই তিনি বেছে নিলেন আওয়ারা শব্দটি। আমি এক যাযাবর এর ভাষান্তর করলেন – আওয়ারা হুঁ, হাঁ ম্যায় আওয়ারা।


আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই পাঠকদের।