হে মহান বিশ্বকবি,
"তোমায় চেয়ে আছি বসে পথের ধারে সুন্দর হে।"


প্রত্যেক মহাপুরুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা থেকে হয়ে যায় কিছু বিশাল সৃষ্টি যা আমাদের নতুন করে দেয় বাঁচবার প্রেরণা। এনে দেয় মনে দৈনন্দিন জীবনে মনের শক্তি ও মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা।


বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পেছনে এরকম কিছু ঘটনা ঘটেছিলো কবির জীবনে যা এনে দিলো আমাদের বাঙালির গর্ব সেই অমূল্য নোবেল পুরস্কার টি। অনেকের হয়তো জানা আবার অনেকের হয়তো অজানা। যাদের জানা, তারা একবার মনটাকে ঝালিয়ে নিতে পারেন, আর যাদের অজানা, তাদের জন্যে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা মাত্র ।


"তোমার কাছে খাটে না মোর কবির গরব করা ----
মহাকবি, তোমার পায়ে দিতে চাই যে ধরা।"


বিশ্বকবি হয়ে যিনি একথা বলতে পারেন তাঁর চরণধূলি নিয়ে শুরু করি আমার এই আজকের নিবেদন:-


একথা কারুর অজানা নয় যে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ করে যার নাম দেয়া হয়েছিল " সং অফারিংস" (SONG OFFERINGS ) . প্রথম সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় লন্ডনে ১৯১২ সালে।গীতাঞ্জলিতে আছে মোট ১৫৭ টি গান/কবিতা। তিনি তার থেকে বেছে নিয়েছিলেন ৫৩ টি কবিতা ও গান।
১৯১২ সালের প্রথম দিকে তাঁর লন্ডন যাবার কথা প্রায় পাকা। হঠাৎ বাধ সাধলো তাঁর শরীর। অর্শ রোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। লন্ডন যাওয়া স্থগিত করতে হলো। ঠিক করলেন শিলাইদহে গিয়ে কিছুদিন বিশ্রাম নেবেন। তাঁর প্রিয় নদী পদ্মা নদী।নৌকোতে  বসে কাব্য রচনা তাঁর খুব ভালো লাগতো। তাই তিনি ঠিক করলেন নৌকোতে বসে গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ করবেন। শুরু হয়ে গেলো কাজ।সেদিন তিনিও কি জানতেন যে এই অনুবাদ হয়ে যাবে বিশ্বের একটি সেরা সৃষ্টি আর এনে দেবে নোবেল পুরস্কার ? অনুবাদ করেন আর বাতিল করেন। কিছুতেই তাঁর মনের মতো হচ্ছিলো না যেন অনুবাদগুলো।খালি ভাবতে লাগলেন এগুলো যেন ঠিক ‘SCHOOL BOY EXERCISE’ । যাই হোক শেষ পর্যন্ত গীতিমাল্য থেকে ১৬ টি, নৈবিদ্য থেকে ১৫ টি, খেয়া থেকে ১১ টি, শিশু থেকে ৩ টি, কল্পনা থেকে ১ টি,উৎসর্গ থেকে ১ টি, স্মরণ থেকে ১ টি, সচলায়তন থেকে ১ টি গান/কবিতা বাছাই করে ইংরেজি গীতাঞ্জলির অনুবাদ বিন্যাস করলেন। তৈরী করলেন এক পানডুলিপি।


ততদিনে কবি মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠেছেন! এবারে যাবার পালা। বোম্বাই বন্দর থেকে জাহাজে উঠলেন ২৭ শে মে ১৯১২ লন্ডনের উদ্দেশ্যে। সঙ্গে গেলেন প্রিয় পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। আর তার সঙ্গে সেই মহামূল্যবান পানডুলিপি। লন্ডনে জাহাজ ভিড়লো ১৬ ই জুন , ১৯১২ । তিনি যখন নিজের স্বরচিত কবিতার অনুবাদ করতেন তখন আক্ষরিক বাহুল্য বর্জন করে শুধু তার ভাবটি গ্রহণ করতেন। এভাবেই তিনি গীতাঞ্জলির অনুবাদগুলি করেছিলেন । কবি ইয়েটস পুস্তকাকারে প্রকাশ করার আগে কিছু সম্পাদনার কাজ করেছিলেন এবং তিনি নিজে এই সং অফারিংস এর ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন।


তাঁর নিজের মুখে কিছু গল্প শোনা যাক। যে গল্প তিনি শুনিয়েছিলেন মংপু তে মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে অবস্থান কালে।
"প্রথম যখন ইংরেজি তর্জমা করি, একটু মাত্র বিশ্বাস ছিল না যে, সে ইংরেজি পাঠ্য হবে। অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে এন্ড্রুজ অনুবাদ করে দিয়েছেন।  বেচারা এন্ড্রুজ শুনে ভারী লজ্জা পেতেন। রোথেনস্টাইনের বাড়িতে ইয়েটস যেদিন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে সভার আয়োজন করলে গীতাঞ্জলি শোনবার জন্যে, সে যে কি সংকোচ বোধ করেছিলুম বলতে পারিনে।  বার বার বলেছি কাজটা ভালো হবে না। ইয়েটস শুনলে না কিছুতেই । অদম্য সে। করলো আয়োজন, বড় বড় সব লোকেরা এলেন। হলো গীতাঞ্জলি পড়া।  কারো মুখে একটি কথা নেই------চুপ করে শুনে চুপচাপ সব বিদায় নিয়ে চলে গেলো,---না কোনো সমালোচনা, না প্রশংসা, না উৎসাহসূচক একটি কথা। লজ্জায় সংকোচে আমার তো মনে হতে লাগলো ধরণী দ্বিধা হও ।  কেন যে ইয়েটস এর পাল্লায় পড়ে করতে গেলুম একাজ। আমার আবার ইংরেজি লেখা, কোনোদিন শিখেছি যে লিখবো? এই সব মনে হয় আর অনুতাপ অনুশোচনায় মাথা তুলতে পারিনে। তার পরদিন থেকে আসতে লাগলো চিঠি, উচ্ছসিত চিঠি, চিঠির স্রোত ;প্রত্যেকের কাছ থেকে চিঠি এলো একেবারে অপ্রত্যাশিত রকমের। তখন বুঝলুম, সেদিন ওরা এতো Moved হয়েছিল যে কিছু প্রকাশ করতে পারেনি। ইংরেজরা সাধারণত একটু চাপা, তাদের পক্ষে তখনি কিছু বলা সম্ভব ছিল না। যখন চিঠিগুলো আসতে লাগলো কি আশ্চর্য যে হয়েছিলুম। এ তো আমি প্রতাশ্যাও করিনি, কল্পনাও করিনি। বন্ধু ইয়েটস খুব খুশি হয়েছিল"


পাশ্চাত্যে সমালচনা
কবি মে সিনক্লেয়ার উপস্থিত ছিলেন সেই গীতাঞ্জলি পাঠের সময়ে।রবীন্দ্রনাথের কবিতায় অভিভূত হয়ে তিনি নিঃসংকোচে লিখেছিলেন :
“রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মানুষের সাধারণ আবেগমথিত নিবেদনের মিলন হয়েছে এমন এক সঙ্গীত ও ছন্দে যা সুইনবার্র্নর চেয়েও পরিশীলীত। এমন এক সঙ্গীত ও ছন্দ যা পশ্চিমী শ্রোতার কাছে অচিন্তনীয়, যাতে আছে শেলীর অপার্থিব চেতনা, অদ্ভুত সূক্ষ্মতা ও তীব্রতা.... এবং তা এমন সহজিয়া রীতিতে যাতে এই যাদুকরী-আবেশকেও মনে হয় পৃথিবীর সবচে’ স্বাভাবিক রূপবন্ধ।


দি টাইমস্ (সাহিত্য সাময়িকী) :- " যে-সমাজে ভাববাদিতা বিপুলভাবে বর্তমান, সে-সমাজে প্রাণময় শিল্প হিসেবে বেঁচে থাকতে হ’লে কবিতাকে উৎক্রান্তি সাধন করতেই হবে। তা’ না হ’লে, শিল্পের খাতিরে, কবি-শক্তি পর্যবসিত হবে অচল মননশীলতায়, ব্যর্থ হবে নিছক বিদগ্ধ ব্যতিরেকে অন্য কারো মনে সাড়া জাগাতে। ভাবকে জয় করতে না-পারলে ভাবের কাছে পর্যদুস্ত কাব্য পরিণত হ’বে গদ্যে। অতীতে কবিতা যেমন ঘটনা-আলোড়িত আবেগের বাহন হয়েছে, তেমনি (এখন) কবিতাকে লিখতে হবে কী ক’রে ফুটিয়ে তোলা যায় ভাবোৎসারিত আবেগ ; আর তা’ করতে যেয়ে কবিতাকে সেই কবিতাই থাকতে হ’বে যার রয়েছে প্রৌঢ় সাংগীতিকতা, উপমা-অলংকার আর নিষ্কম্প্র মূল্যবোধ। আর এই সমস্যাতেই এ যুগের কবিতা আক্রান্ত্র, এর অস্তিত্ব বিপন্ন ; এবং অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ইয়েটস সাহেব সেই ভারতীয় কবির রচনাকে সানন্দে সম্ভাষণ জানাবেন যিনি অনায়াসে ঐ সমস্যাটির সমাধান করেছেন বলে মনে হয়।"


এথেমিয়াম পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, "তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) কবিতামালায় এমন এক স্নিগ্ধ প্রশান্তি রয়েছে যার শিক্ষা পশ্চিমের অশান্ত-চিত্ত মানুষের বড় দরকার।"


টি. ডব্লু. রলেস্টন ১১০০ শব্দের দীর্ঘ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, "জীবনের মৌল বিষয়ের সঙ্গে এই কবিতাগুলি এতো ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট যে এর চেতনা, এবং এমনকি, এর বাকপ্রতিমার একটি বিশ্বজনীন তাৎপর্য রয়েছে।


দি নেশান পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, "ভুলে যাও ইয়েটস্-এর তদ্বির, ভুলে যাও যে ‘এটি সাহিত্য-বিশ্বের একটি শীর্ষ-ঘটনা’, এবং (তবু) গীতাঞ্জলি’তে পাবে প্রণয়াকুল হেমন্তের নিখাদ পুষ্পকোরক যাতে রয়েছে (মানুষের) সনাতন বিশ্বাসের ইঙ্গিত।


নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি


১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ফরাসি লেখক এমিল ফগ। একাডেমী সদস্য ভার্নার লন হেইডেনস্টাম রবীন্দ্রনাথের পক্ষে প্রশস্তিপূর্ণ এমন জোরালো ও লিখিত বক্তব্য দেন যাতে সকল সংশয়ের অবসান হয় এবং রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর বুধবার সাহিত্যে নোবেল ঘোষণা করা হয়। পর দিন খবরটি ইংল্যান্ডের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মুদ্রিত হয় ; কিন্তু তা বিলম্বে কলকাতায় পৌঁছে। ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় তারবার্তার মাধ্যমে খবর আসে যে রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।


জাতীয় লজ্জা :


আজ ভাবতে  লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে যায় যে সেই কত পরিশ্রমের দ্বারা সংগৃহিত নোবেল পুরস্কারটি আমার রক্ষা পর্যন্ত করতে পারলাম না! এতো অক্ষম আর অকৃতজ্ঞ আমরা হতে পারলাম? যা ভোলার নয়, যা মনে করলে জীবন সার্থক হয়ে যায় সেটি এমন অবহেলায় আমরা হারিয়ে ফেললাম সারাজীবনের মতো?
২৫শে মার্চ ২০০৪, বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ১৫মিনিট। আর দশটা দিনের মত কর্মচাঞ্চল্যে মেতে উঠেছে শান্তিনিকেতন। যথারীতি ক্লাশ করেছে বিশ্ব ভারতীর ছাত্ররা। হঠাৎ বিনা মেঘে ব্জ্রপাতের মত খবরটা ছড়িয়ে পড়ল নোবেল চুরি হয়েছে। সবাই ছুটল রবীন্দ্রনাথের বাড়ী উত্তারায়নের দিকে। শুধু নোবেল কেন আরো অনেক রবীন্দ্র স্মৃতি থেকে শুরু করে কবি গুরুর অনেক ব্যাবহার্য জিনিসপত্র। এই উত্তরায়নই আজ রবীন্দ্র সংগ্রহ শালা।
আজ তেরোটা বছর পেরিয়ে গেলো সেই অতি মুল্যবান বাঙালির ধন আর খুঁজে পাওয়া গেলোনা!


উপসংহার:-
হৃদয়ে আজ শুধু একটি কথাই শুধু নীরবে ধ্বনিত হচ্ছে :


“ In one salutation to thee -----
  In one salutation to thee-------


'একটি নমস্কারে প্রভু একটি নমস্কারে'


তথ্য সংগ্রহ :
বিভিন্ন উইকিপিডিয়া এবং মৈত্রেয়ী দেবী রচিত "মংপুতে রবীন্দ্রনাথ"