'কবিতিকা' অর্থাৎ যার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায় 'ছোট কবিতা'।
যেমন : ভার্স (verse) : মাত্রাবৃত্তে লেখা এক লাইনের কবিতা।
            দোঁহা : দু লাইনের কবিতা -- মহান কবি "কবির' এর রচিত দোঁহা খুবই বিখ্যাত।
            কাপলেট (Couplet) : দুটি পংক্তির ছন্দ ও অস্ত্যমিল দিয়ে লেখা এক স্তবকের কবিতা।
            হাইকু (Haiku) : জাপানি ভাষায় লেখা ছোট্ট কবিতা। অস্ত্যমিল ছাড়া মাত্র তিনটি পংক্তি থাকে।
            মেমোরিয়াম স্ট্যাঞ্জা (Memorium Stanza) : লর্ড টেনিসন প্রথম এ ধরনের কবিতা রচনা করেন। চতুস্পদী এই কবিতার চরণ বিন্যাস ও শব্দের উচ্চারণে বিশেষত্ব থাকে।


ঠিক একইভাবে  'রুবাইয়াৎ' রচিত হয়েছিল 'কবিতিকা'র ঢঙে। অর্থাৎ চার পংক্তির কবিতা। প্রথম দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনের শেষে অন্তমিল থাকবে কিন্তু তৃতীয় লাইন এ কোনো অন্তমিল থাকবেনা। অর্থাৎ তৃতীয় লাইনটি সম্পূর্ণ স্বাধীন। মাত্রার সংখ্যা এক না হলেও চলবে। রুবাইয়াৎ কবিতিকার আবিস্কারক বিখ্যাত ইরানি কবি ও গণিতবিদ  ওমর খৈয়াম। একইসাথে একজন দার্শনিক, কবি, গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ।  আবার তিনিই লিখেছেন মধুর সব রুবাইয়াৎ কবিতা। কখনো বর্ষপঞ্জিকা নিয়েও কাজ করেছেন। আবার কখনো চতুষ্পদী কবিতার অমর সংকলন ‘রুবাইয়াত’ রচনা করেছেন তিনিই। আধুনিক বীজগণিতের ভিত্তি তৈরি হয়েছে তার হাতে, কাজ করেছেন ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নিয়েও। ভূগোল, খনিজবিজ্ঞান, আইন, এমনকি সঙ্গীতও বাদ যায়নি তার জ্ঞানপিপাসার তালিকা থেকে। জীবনের শেষ দিকে এসে হয়েছেন শিক্ষক; শিক্ষাদান করেছেন ইরানে সিনার দর্শন ও গণিত বিষয়ে। তিনি সত্যি অসাধারণ, অতুলনীয়, অনুপম; তিনি ওমর খৈয়াম।
অনেক হ্যাপা [হ্যাপা শব্দটি স্ল্যাং বলে ভুল করবেন না প্লিজ ;শব্দটির অর্থ ঝক্কি, ঝামেলা চলতি ভাষায়)]পুইয়ে গত সপ্তাহে ঢাকা 'রুবি এন্টার-প্রাইজ' থেকে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পরে হাতে পেলাম আমার বহু আকাঙ্খিত একটি বই  "রুবাইয়াৎ-ই-ওমর-খৈয়াম"। অনুবাদক "কাজী নজরুল ইসলাম" । আর তার থেকেই এই রচনাটির অনুপ্রেরণা পেলাম। ইচ্ছে হলো আসরের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করি।  
ওমরের কাব্য ছয় ভাগে বিভক্ত:-
১) 'শিকায়াত-ই-রোজগার' -- গ্রহের ফের অথবা অদৃষ্টের প্রতি অনুযোগ।
২)  'হজও'-- অর্থাৎ জ্ঞানীদের দাম্ভিকতা ও মূর্খদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ।
৩) 'ফিরাফিয়া" ও 'ওসালিয়া" --- প্রিয়ার বিরহে অথবা প্রিয়ার মিলনে লেখা কবিতা।
৪) "কুফরিয়া" -- ধর্মশাস্ত্র-বিরুদ্ধ কবিতা।
৫) "বাহারিয়া"-- বসন্ত, ফুল.বাগান,ফল,পাখি ইত্যাদির প্রশংসায় রচিত কবিতা।
৬) "মুনাজাত" - অর্থাৎ খোদার কাছে প্রাথনা।  এ প্রার্থনা অবশ্য সুফির প্রার্থনার মতো হাস্য-জড়িত।
{'সুফি' কথাটির অর্থ হচ্ছে সুফিয়াত বা তাসাউফ।এটি একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়।মরমীতত্ত্বের সাধনায় কারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি নিজেকে এইরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন ইসলামের পরিভাষায় তিনি সুফি নামে অভিহিত হন।}


ইউরোপিয়ান কবি  'এডওয়ার্ড ফিট্জেরাল্ড'  সর্বপ্রথম ওমর খৈয়াম এর ৬০ খানা কবিতা অনুবাদ করে সারা ইউরোপে সাড়া জাগিয়ে তুলেছিলেন। রুবাইয়াতের মতবাদের জন্যে তৎকালীন ধর্মগোঁড়া দের খৈয়ামের প্রতি আক্রোশ ছিল এবং তাঁকে নানাভাবে এর জন্যে হেনস্থা হতে হয়েছিল।নজরুলের ফার্সি ভাষা জানার দরুন খৈয়ামের মূল কবিতা থেকে তিনি অনুবাদ করে ছিলেন প্রায় দুশোটির মতো রুবাইয়াৎ।
তার মধ্যে আমার ভালো লাগা কিছু তুলে ধরলাম এখানে:-----
ওমরের প্রধান বিদ্রোহ ছিল ধর্মগুরুদের বিরুদ্ধে।নজরুল নিজে যেহেতু বিদ্রোহী কবি ছিলেন, সেজন্যে তাঁর সঙ্গে খৈয়ামের রুবাইয়াতের সঙ্গে বোধহয় সখ্যতা হয়েছিল একটু বেশি পরিমাণে।
(১)
" খা'জা! তোমার দরবারে মোর একটি শুধু আর্জি এই
  থামাও উপদেশের ঘটা, মুক্তি আমার এই পথেই।
  দৃষ্টি-দোষে দেখছো বাঁকা আমার সোজা সরল পথ
  আমায় ছেড়ে ভালো করো, ঝাপসা তোমার চক্ষুতেই।
(২)
" করছে ওরা প্রচার --- পাবি স্বর্গে গিয়ে হুরপরী,
  আমার স্বর্গ এই মদিরা, হাতের কাছেই সুন্দরী।
  নগদে যা পাস্ তাই ধরে থাক, ধারের পণ্য করিসনে,
  দূরের বাদ্য মধুর শোনায় শূন্য হাওয়ায় সঞ্চরি ।


(৩)
" বুলবুলি এক হালকা পাখায় উড়ে যেত গুলিস্থান,
   দেখলো হাসিখুশি ভরা গোলাপ লিলির ফুল-বাগান।
   আনন্দে সে উঠলো গাহি, "মিটিয়ে না সাধ এই বেলা,
   ভোগ করতে এমন দিন আর পাবিনে তুই ফিরিয়ে প্রাণ"।


(৪)
   "দেখতে পাবে যেথায় তুমি গোলাপ লালা ফুলের ভিড়,
    জেনো, সেথায় ঝরেছিল কোনো শাহানসার রুধির।
    নার্গিস আর গুল-বোনোসার দেখবে যেথায় সুনীল দল,
    ঘুমিয়ে আছে সেথায় --- গালে তিল ছিল যে সুন্দরীর।


ভালো করে লক্ষ্য করে দেখুন প্রত্যেকটি রুবাইয়াৎ চতুস্পদী তে প্রথম,দ্বিতীয় ও চতুর্থ লাইনে অন্তমিল রয়েছে কিন্তু তৃতীয় লাইনে কোনো অন্তমিল নেই। আর এটাই রুবাইয়াৎ এর বিশেষত্ব। নজরুলের নিজের কথায় ..... "ওমরের বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা কে আমার মতো আনাড়ি সওয়ার যে বাগ মানাতে পারবে, সে ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে এটুকু জোর করে বলতে পারি, তাঁর ঘোড়া আমার হাতে পড়ে চতুস্পদী ভেড়া-ও হয়ে যায়নি --প্রাণহীন চার-পায়াও হয়নি । আমি ন্যাজ মলে মলে ওর ---অন্তত তেজটুকু নষ্ট করিনি।"


আমার এই লেখার শেষে কৃতজ্ঞতা নিবেদনের পালা..................
এই বইটি হাতে না পেলে আমার এই তথ্যগুলো সরবরাহ করা সম্ভব ছিল না। তাই ঢাকা,বাংলাদেশ 'রুবি এন্টারপ্রাইজে'র  কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আর সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ থাকলাম আমার আসরের প্রিয় বন্ধুদের কাছে, যারা এই অত্যন্ত নবিস লেখকের বকবকানি ধৈর্য ধরে শুনলেন বা পড়লেন।
সবার শেষে কৃতজ্ঞ ইন্টারনেটের কাছে যার থেকে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে।


আজ আসি তাহলে বন্ধুরা? আবার দেখা হবে।


সবাই ভালো থাকুন।