আজকের আলোচনা অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে।বাংলা তিন ছন্দের মধ্যে অক্ষরবৃত্তের স্থান সবার উপরে।মুক্তক অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সেরা বাংলা কবিতাগুচ্ছ লেখা হয়েছে।
স্বরবৃত্ত যেন এক শিশু। গড়গড় করে কবিতা বলে।মাত্রাবৃত্ত যেন এক যুবক।একটু আধটু বুঝেছে।আর অক্ষরবৃত্ত হল পরিণত মানুষ।বুঝে শুনে মতামত দেয় গম্ভীর ভাবে।
অক্ষরবৃত্ত এক সর্বগ্রাসী ছন্দ।যুক্তাক্ষরকে অনায়াসে গিলে খায়।অনেক বাংলা শব্দ চার অক্ষরের।কিন্তু উচ্চারণ হয় তিন অক্ষরের মত।এদের তিন মাত্রাই দেয় অক্ষরবৃত্ত। যেমন-
চারজন, হাড়গিলে, কাতরাতে, কলকাতা, বুলবুলি উচ্চারণের সময়ে হয়ে যায় চার্জন,হার্গিলে,কাত্রাতে,কল্কাতা, বুল্বুলি। তাই এদের মূল্য তিন, চার নয় অক্ষরবৃত্তের কাছে।মাত্রাবৃত্ত কিন্তু এদের পুরো চার মাত্রার মূল্য দেয়।এটাই অক্ষরবৃত্তের সংগে মাত্রাবৃত্তের প্রধান পার্থক্য।


একই ভাবে কিছু তিন অক্ষরের শব্দ উচ্চারণ এর সময়ে গুটিয়ে দুই অক্ষরের শব্দে পরিণত হয়।তাই তাদের মূল্য দু মাত্রা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে।যেমন- বাজনা, খাজনা, সজনে ইত্যাদি গুটিয়ে গিয়ে বাজ্না,খাজ্না,সজ্নে হয়ে যায়।আসলে লেখার অক্ষর নয়, উচ্চারণের কানই ছন্দের প্রধান অঙ্গ। এবং তাইই হওয়া উচিত কারণ, ভাষা যতটা না লেখার জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি বলা ও শোনার জন্য।


তাই চোখ নয়, কান।কানের উপরেই নির্ভর করতে হবে ছন্দের জন্য।ছন্দ আসলে গানের মতই শোনার জিনিস।আর গান মানেই তো কান।তান আর কান না থাকলে গান কে শুনবে?
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে একটা সুরেলা তান থাকে।এই কারণেই একে তানপ্রধান ছন্দও বলা হয়।'হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি... ' বা 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে' লাইনগুলোর তান লক্ষ্য করুন।
এবারে আসব অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সহজে কবিতা লেখার আলোচনাতে।কারণ আমরা ছান্দসিক হতে চাই না, কবি হতে চাই।
এই ছন্দে কবিতা লেখা খুব সহজ।কারণ মোটামুটি যত অক্ষর, তত মাত্রা।শুধু খেয়াল রাখতে হবে উচ্চারণের সময়ে অক্ষরগুলো গুটিয়ে যাচ্ছে নাকি।গুটালেই মাত্রা কমবে।যুক্ত অক্ষরকে একটি অক্ষরেরই মূল্য দেয় এই ছন্দ।
তিনের পাশে তিন, দুই এর পাশে দুই এই হল মূলমন্ত্র অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখার।বিজোড়ে বিজোড় গাঁথ, জোড়ে গাঁথ জোড়।শুধু এটুকু মনে রেখে মনের সুখে কবিতা লিখুন এই ছন্দে।একদম সঠিক কবিতা হবে।
আসুন আমরা লিখি কিছু।
কি নিয়ে লেখা যায়? প্রেম? ভাল, ভাল।প্রেম অতি উপাদেয় উপাদান কবিতা লেখার।শুধু মাথায় রাখছি তিনের পাশে তিন আর দুই এর পাশে দুই।


ওগো নারী,
তোমার সাজানো ঘরে দুদণ্ড বিশ্রাম নিতে পারি?
পেতে পারি পিপাসার জল?
পেড়িয়ে এসেছি মরুভূমি,অনেক যুদ্ধের কোলাহল।
বড় ক্লান্ত আজ
তোমার বাগানে বসে বাজাব এস্রাজ।


এবারে যা লেখা হল তার ছন্দ বিশ্লেষণ :-


ওগো /নারী,২/২
তোমার /সাজানো /ঘরে ৩/৩/২
দুদণ্ড /বিশ্রাম/ নিতে/ পারি?৩/৩/২/২
পেতে/ পারি/ পিপাসার/ জল?২/২/৪/২
পেড়িয়ে/ এসেছি/ মরুভূমি,৩/৩/৪
অনেক/ যুদ্ধের/ কোলাহল।৩/৩/৪
বড় /ক্লান্ত /আজ ২/২/২
তোমার /বাগানে /বসে ৩/৩/২
বাজাব /এস্রাজ।৩/৩


শেষ লাইনে বাজাব না লিখে যদি বাজবে লিখতাম তা হলে কি হত? বাজবে সঙ্কুচিত হয়ে হয়ে যেত 'বাজ্বে' যা দু মাত্রার।ফলে দুই এর পাশে তিন হয়ে ভুল হয়ে যেত।
'পিপাসার জল', (৪/২)না লিখে যদি লিখতাম 'তৃষ্ণার জল' (৩/২)তাহলেও ভুল হয়ে যেত।বিজোড়ে জোড় গাঁথা হয়ে যেত।যদিও অর্থ একই থাকত।শব্দচয়ন কত গুরুত্ববহন করে, সেটা এখান থেকে বুঝতে পারা যাচ্ছে।


মাত্রা গোনার নিয়ম যত অক্ষর, তত মাত্রা।তবে উচ্চারণের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।


উচ্চারণের গুরুত্ব বুঝবার জন্য একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করুন।


"কালকা মেলে টিকিট কেটে সে
কাল গিয়েছে পাহাড়ের দেশে।"


কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর এই দু-লাইনের কবিতা দেখুন।
কালকা  মেল উচ্চারণে হচ্ছে কাল্কা মেল, আর 'কাল গিয়েছে ' যদিও দুটি আলাদা শব্দ, পাশাপাশি বসার জন্য উচ্চারিত হচ্ছে 'কাল্গিয়েছে' হিসাবে।ছান্দসিক কবি একে বলেছেন অক্ষরবৃত্ত ছন্দে শব্দের অসবর্ণ বিবাহ!
ছন্দ বিশ্লেষণ :-


"কালকা মেলে/ টিকিট/ কেটে সে ৪/৩/৩
কাল গিয়েছে/ পাহাড়ের/ দেশে।"৪/৪/২


কাল্কামেল ৪ মাত্রা।কাল্গিয়েছে ৪ মাত্রা।দুটি সমমাত্রিক লাইন।১০ মাত্রার।৪+৩+৩=৪+৪+২
বিজোড়ে বিজোড়,  জোড়ে জোড় হিসাবে লেখা।তাই সঠিক অক্ষরবৃত্ত।


জীবনানন্দ দাসের বেশিরভাগ কবিতা অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা।জীবনানন্দের কবিতা পড়ুন আর ছন্দ নিজে বিশ্লেষণ করুন।


অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
জীবনানন্দের 'অদ্ভূত আঁধার এক'- কবিতাটির বিশ্লেষণ :-


অদ্ভুত আঁধার এক/৩-৩-২ এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,/৪-৪-২
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি/২-২-৪-২
আজ চোখে দ্যাখে তারা;/২-২-২-২
যাদের হৃদয়ে কোনো/৩-৩-২ প্রেম নেই – প্রীতি নেই –/২-২-২-২ করুণার আলোড়ন নেই/৪-৪-২
পৃথিবী অচল আজ/৩-৩-২
তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।/৩-৫-২
যাদের গভীর আস্থা/৩-৩-২ আছে আজো মানুষের প্রতি/২-২-৪-২
এখনো যাদের কাছে/৩-৩-২
স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়/৪-২-২-২
মহত্‍‌ সত্য বা রীতি,/৩-৩-২
কিংবা শিল্প অথবা সাধনা / ২-২-৩-৩
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য/৪-৪-২
আজ তাদের হৃদয়/ ২-৩-৩


দেখা যাচ্ছে নির্ভুল অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতা। বিজোড়ে বিজোড়,  জোড়ে জোড় গাঁথা হয়েছে।সঙ্গে রয়েছে একটানা এক তানের প্রবাহ।দুই অক্ষরের শব্দের পাশে তিন অক্ষরের শব্দ বসানোর জন্য মাঝখানে এক অক্ষরের শব্দ নিয়ে আসা হয়েছে।এভাবেই অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখতে হয়।