যদি ভুলে যাও মোরে  জানাব না অভিমান’ – বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণ যুগে সৃষ্ট এই  কাল জয়ী গানকে  কি করে ভুলে যাই ...।এ গানের স্রষ্টাকে  যদি ভুলে যাই  - তিনি আর অভিমান  করবেন না জানি, কিন্তু বিবেকের অভিমান রোধ করি কি করে। ভুলে যেতে যে পারি না।
আজও ঘুম থেকে উঠেই দূরে বা কাছে থেকে ভেসে আসে যে সুর, তার মধ্যে একটা অন্তত স্বর্ণ যুগের বাংলা গান।বাংলা গানের স্বর্ণ যুগ বলতে বুঝি ১৯৫০এর দশক থেকে ১৯৭০ দশকের আধুনিক  ও ছায়া ছবির বাংলা গান। স্বর্ণ যুগের বাংলা গানের সেইসব কিংবদন্তী স্রষ্টাদের মধ্যে অন্যতম যাদুকর  -  গীতিকার  প্রনব রায়ের  অসংখ্য  বিখ্যাত গান ভুলি কি করে। তাঁকে  তো ভোলা যায় না ।
ইতিহাস  যখন রচিত হয়, বহু নামের  ভিড়ে কিছু নাম আপন স্বাক্ষর রেখে যায় উজ্জ্বলতার সাথে। বাংলা গানের ইতিহাসে গীতিকার রুপে পঞ্চকবির(বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী কবি নজরুল ,রজনীকান্ত সেন,অতুলপ্রসাদ সেন আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ) পাশাপাশি কালজয়ী বহুগানের স্রষ্টা যে সকল গীতিকার স্বর্ণযুগের বাংলা গানের ইতিহাসে  উজ্জ্বল আপন স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন  গীতিকার প্রনব রায়।তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা গানের যাদুকর ।
১৯১১ সালের ৫ই  ডিসেম্বর , কলকাতার বড়িশায়,বিখ্যাত সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে তাঁর জন্ম।পিতার নাম  ছিল দেবকুমার রায় চৌধুরী ।  ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে পড়াশুনা শেষ করে তিনি কলেজ জীবন কাটান  প্রথমে সিটি কলেজে । অন্তর্মুখী স্বভাবের প্রনব রায়ের, ছোটবেলা  থেকেই ছিল কবিতার প্রতি  আসক্তি। ছাত্র জীবন থেকেই  কবিতা,ছোটগল্প প্রবন্ধ প্রভৃতি লেখা শুরু করেন তিনি।   ছাত্রাবস্থা থেকেই   বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় (বসুমতি,পুস্পপত্র,শিশির ইত্যাদি) তাঁর লেখা  প্রকাশিত হতে থাকল ...।
মেট্রিকুলেশনের পরে কলেজে যখন ভর্তি হলেন, এই সাহিত্যচর্চার সাথে সাথে তখনকার নামকরা সঙ্গীত শিল্পী ও সুরকার শ্রী উমাপদ ভট্টাচার্যের(ফেলুদা)  প্রেরণায় খেয়ালের বশে দু –চারটে গানও লিখে ফেললেন । ফেলুদা সুর দিলেন তাতে, যদিও তা আর রেকর্ড করা হয়ে ওঠে নি  । কিন্তু, গান শোনা , গান গাওয়া –র প্রতি আসক্ত হয়ে উঠলেন তিনি । এরপর ফেলুদার সহায়তায় কাজী নজরুল ইসলামের সংস্পর্শে এলেন তিনি, এবং ক্রমে তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত হয়ে উঠলেন । খুঁজে পেলেন এক নতুন পথের সন্ধান।
কলেজে পড়ার সময় (প্রথমে সিটি কলেজ তারপরে বি ই কলেজ) বিশ্ববন্ধু  পত্রিকায় ’কমরেড’ নামে ব্রিটিশ বিরোধী এক কবিতা লেখার জন্যে তাঁকে কারাবরণ করতেও হয়ে ছিল ।এই সময় থেকেই পড়াশুনায় ছেদ পড়ে ।  কিন্তু  এতে কি আর  তাঁকে  রোখা যায় ...। স্বদেশী চেতনার প্রেক্ষাপটে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হতে থাকল – সাহিত্য পত্রিকা...’নাগরীক’। এরপর ‘রহস্য রোমাঞ্চ’ নামেও একটি পত্রিকার প্রকাশনা শুরু করেন তিনি।জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ’রহস্য রোমাঞ্চ’ র জন্য গল্প লিখে গেছেন তিনি।
অন্তর্মুখী স্বভাবের প্রনব রায় আত্মভোলা হিসেবে লক্ষ্যহীন ভাবে সরল জীবন যাপন করতেই  পছন্দ করতেন।কিন্তু, কাজী সাহেবের সাথে তাঁর পরিচয় এবং ভাবশিস্য  হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার অদম্য চেষ্টা তাঁর জীবন প্রবাহকে অন্য ধারায় বয়ে নিয়ে যায় ।এরপর কাজী সাহেব যখন এইচ এম ভি ‘র দায়িত্ব পান তখন থেকে সম্পর্ক আরও গভীর হয়।  ১৯৩৬ সালে একদিন, কাজী সাহেব ওঁকে আকাশবানীর জন্য চারটি প্রেমের গান লিখে দিতে বললেন। প্রতিটি গানের জন্য নাকি ৫ টাকা করে  পাওয়া যাবে।সেই থেকেই পেশাদার গীতিকার হিসেবে যাত্রা শুরু। ১৯৩৭ সালে প্রথম তাঁর গান রেকর্ড আকারে প্রকাশিত হল – যূথিকা রায়ের কণ্ঠে ...” আমি ভোরের যূথিকা”। যদিও ছায়াছবির গানে গীতিকার রুপে তাঁর  আত্মপ্রকাশ ১৯৩৬ সালে (পণ্ডিত মশাই )।কাজী সাহেব প্রনব রায়ের লেখা গান সম্বন্ধে এক প্রবন্ধে লিখলেন , ‘এই সময়ে আমরা এমন এক যুব  গীতিকারকে পেয়েছি যিনি গানের জগতে এক নতুন তারা রুপে সকলকে অবাক করেছেন, তিনি হলেন প্রনব রায়। তাঁর লেখা গানের শব্দ যেন গাছ থেকে সদ্য তুলে আনা ফুল যা  কিনা গন্ধে ভরপুর, বর্ণে উজ্জ্বল।‘
শুরু হল নতুন এক  যুগের । তারপর একের পর এক অসাধারণ সৃষ্টি ...।   একের পর এক  অসাধারন সব কালজয়ী গানের স্রষ্টা যে তিনি-ই - ’মধুর আমার মায়ের হাসি’(সুর ও কণ্ঠ –সুধীরলাল),’তুমি আজ কত দূরে’(সুর –কমল দাশগুপ্ত, কণ্ঠ- জগন্ময় মিত্র),’এই কি গো শেষ দান’ (সুর –কমল দাশগুপ্ত,কণ্ঠ –ফিরোজা বেগম), ‘কতদিন দেখিনি  তোমায়’ (সুর – কমল দাশগুপ্ত, কণ্ঠ – মান্না দে) ..কোনটা আগে বলি বলুন তো .।কমল দাশগুপ্তের সুরে  তাঁর লেখা ‘ সাঁজের তারায় ...’ বলে যে গানটি তখন খুব বিখ্যাত হয়েছিল যূথিকা রায়ের কণ্ঠে --- সে গানকে ধরা হয়েছিল বাংলা আধুনিক গানের ধারার পরিবর্তনকারী গান রুপে। আজও কান পাতলে সে সুর শোনা যায় ।
প্রথম দিকে তিনি (২ বছর) বসুমতি পত্রিকায়্,  তারপর , পায়ওনিয়র রেকর্ড কোম্পানিতেও  অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করেছিলেন। এরপর আকাশবাণী ও ছায়াছবির জন্য গান লেখার পাশাপাশি প্রথমে নীতিন বসু ও পরে প্রমথেশ বড়ুয়ার সহযোগী পরিচালকরুপে  কাজ করতে শুরু করেন তিনি। কিংবদন্তী গীতিকার রুপে তাঁর প্রধান পরিচয় হলেও তিনি ছিলেন একাধারে     কাহিনীকার ,  চিত্রনাট্যকার , সংলাপ লেখক ,চিত্রপরিচালক এবং অভিনেতা।
সাড়ে তিন হাজারেরও কিছু বেশী গান লিখে গেছেন তিনি। স্বর্ণযুগের সেরা সুরকারদের মধ্যে অন্যতম যেমন কমল দাশগুপ্ত,অনিল বাগচি,সুবল দাশগুপ্ত,হেমন্ত মুখো পাধ্যায়,রবীন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ,সুধীরলাল   প্রভৃতি সুরকারগণ । তাঁর  লেখা  গানগুলি স্বর্ণযুগের প্রায় সকল দিকপাল সঙ্গীত শিল্পীরাই গেয়েছেন ।তাঁদের দিয়ে গাইয়ে প্রচুর অমর গান সৃষ্টি করে গেছেন।
১৯৩৬ সালে  গীতিকার রূপে পণ্ডিত মশাই ছবিতে তাঁর আত্মপ্রকাশ.।১৯৪৬ সালে ’সাত নম্বর বাড়ী ‘ ছায়াছবির জন্য   প্রথম চিত্রনাট্য লেখেন তিনি। এরপর বিখ্যাত  ছায়াছবি  হার জিত(১৯৫৭) ‘ পিতাপুত্র’ (১৯৬৯) , ‘ পরিণীতা’(১৯৬৯)  ,বৌদি(১৯৬৮) , ছবির জন্য  চিত্রনাট্য লেখেন তিনি।  এছাড়া  ব্রাহ্মণ কন্যা (১৯৪১),ফাগুন (১৯৫৮),ভানু গোয়েন্দা জহর এ্যাসিস্ট্যান্ট (১৯৭১) প্রভৃতি  ছবির মূল কাহিনীকার  ছিলেন তিনি।
চলচ্চিত্র পরিচালক  রুপে তাঁর ছবিগুলির মধ্যে অন্যতম হল –রাঙামাটি (১৯৪৯),অনুরাধা, প্রার্থনা ,প্রভৃতি । অভিনেতা রূপে তাঁর আত্মপ্রকাশ পরিণীতা (১৯৬৯), কাঁচ কাটা হীরে (১৯৬৫),থানা থেকে আসছি (১৯৬৫),হারানো সুর (১৯৫৭) ইত্যাদি ছায়াছবিতে। তাঁর লেখা কাহিনী থেকে বিখ্যাত হিন্দি ছায়াছবি তৈরি হয় ‘–বাত এক রাত কি’। যে ছবিতে মুখ্য অভিনয় করেছিলেন দেবানন্দ এবং ওয়াহিদা রেহমান ।
স্বর্ণযুগের প্রচুর বিখ্যাত ছায়াছবির গানের গীতিকার ছিলেন প্রনব রায়। কত নাম আর এই স্বল্প পরিসরে বলব ।তাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি  ছায়াছবির নাম উল্লেখ করতে চাই  যাদের নাম মনে পড়লে অনেক পুরনো দিনের লোকেরাই হয়ত নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হবেন – যেমন ,পৃথিবী আমারে চায় (১৯৫৭),সাহেব বিবি গোললাম১৯৫৬), ঢুলি (১৯৫৪),হারজিত(১৯৫৭), বৈকুণ্ঠের উইল (১৯৫০) ,আরোগ্য নিকেতন(১৯৬৯),পিতা পুত্র (১৯৬৯), কমললতা ,পরিণীতা ,অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী (১৯৬৭), গড় নসিমপুর (১৯৬৮)ভোলা ময়রা ,অভয়ের বিয়ে(১৯৫৭) ,কলঙ্কিত নায়ক(১৯৭০) ইত্যাদি। ১৯৬৫ সালে তিনি 28TH Bengal Film Journalist Association    প্রদত্ত Best  Indian Cinema   for 1964   এর নিরিখে  সেরা গীতিকার পুরস্কার পান । পুরস্কারের প্রত্যাশী ছিলেন না তিনি।বলতেন," ভিখিরী আমার গান গেয়ে ভিক্ষে চাইছে- এটাই বড় পুরস্কার।"
জীবন ও জীবন বোধের গান(তোর জীবন বীনা আপনি বাজে-সুর ও কন্ঠ,সুধীরলাল),বিরহের গান(কতদিন দেখিনি তোমায়-কমল দাশগুপ্ত/মান্না দে,খেলাঘর মোর ভেসে গেছে হায় -সুধীরলাল)প্রেমের গান(তু নিরুপম সুন্দর মনতুমি আছ নয়নে-রবীন চট্টপাধ্যায়/সন্ধ্যা মুখার্জী,এমনি বরষা ছিল সেদিন-কমল/যুথীকা রায়) সব ধরনের গান রচনায় কবি প্রনব রায় অসাধারণ মুন্সীয়ানার পরিচয় দেখিয়েছেন।আজ ও যদি কোথাও শুনতে পাই - "ও মন কখন শুরু কখন যে শেষ...."(শ্যামল ও সন্ধ্যা) গানটি ,দাড়িয়ে পড়ি  অজান্তেই।
কবি প্রনব রায় নতুন প্রজন্মের কাছে বিস্মৃত হতে চলেছে দেখে খুব দুঃখ অনুভব করি। মহান এই গীতিকারকে কখনও যেন ভুলে না যাই।তাঁর মৃত্যুর (১৯৭৫)এত বছর পরেও আমরা ,সঙ্গীত পিপাসু বাঙ্গালী,এখনও পর্যন্ত তাঁকে যোগ্য সম্মান জানাতে পারিনি,বড় ব্যথা লাগে বুকে।তাঁর জন্মদিন  সাড়ম্বড়ে পালন করার কথা কারও মনে থাকে না আমাদের।
BIBLIOGRAPHY:
১.সাবর্ণ চৌধুরী সংগ্রহ শালা আর্কাইভ
২।https://m.imdb.com
3.https://musicplay.wordpress.com kotha o sur
4 .www.milansagar
5.https://en.mwickepedia.org
6.https://telegraphindia
7.infosysbdltd.com.allbook info
8.pronob roy-the wizard of bengali lyrics facebook
9.creative mind - the statesman
10 moviebuff.com