দেখছ কী? উসকো-খুসকো চুল আর আউল
বাউলের মতো আমার চালচলন। এখন এসব
দেখে ভাবছো কী?
বলবো কী, সোম রস পান করেই বেশ আছি।
দেখো, সামনে অগ্নিকুণ্ডে দাউদাউ করে জ্বলছে
যজ্ঞের আগুন। জানো, সে আগুনেই জীবনের
স্বপ্নগুলো কে আহূতি দিয়েছি।
জানতে কি ইচ্ছা করে, কেন? তবে শোনো,
‘বি এড সহ মাস্টার্স ও টেট উত্তীর্ণ হওয়ার
পরে উন্মুক্ত জানালা দিয়ে দেখতে চেয়েছি
ফুল-ফল ও শ্যামল শস্যক্ষেত্র।
মনে পড়ে, শ্রমের যে বীজ বাবা কৈশোরেই
মুঠোতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সেটিকে
অন্তরে রোপণ করতে, তার চারা গজালে
তাকে সেবাযত্ন করতে। দেখবে সে একদিন
বেড়ে উঠে ফুল-ফলে শোভিত হবে।
খোলা জানালা দিয়ে শ্যামল শস্যক্ষেত্র দেখা
হলো কৈ? দেখেছি ধু-ধু মরুভূমি। এ জীবনে
কী যে হলো ভাবতেও কষ্ট হয়।
দেখেছি চারদিকে নৈরাজ্য, সূর্যগ্রহণের মতো
চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।
মনে হলো দুঃশাসনের রাজত্ব। সে যেন তার
বাহিনী নিয়েই ঘটালো অদ্ভুত কাণ্ড। গড়লো
উপনিবেশ, শিক্ষিত বেকারদের সাম্রাজ্যে।
পরিণতি? শিক্ষিত যোগ্য যুবক-যুবতীরা যারা
হকের চাকরীর দাবী জানালো, তাদের ভাগ্যে
জুটলো কত কী!
নির্মম ভাবে মর্যাদার ভিত্তিস্তম্ভকে ভেঙে দিয়ে
করলো চুরমার। ছিনিয়ে ও নিলো তাদের সব
অধিকার। চাকরীগুলো তুললো নিলামে। বিক্রি
শুরু করলো লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে।
জানো, সে খবর পেয়েই আমরা সকলে মিলে
গেছি তার কাছে। আমাদের ন্যায্য দাবীগুলো
মেটাতে অনুরোধ করেও তার কোনও সুরাহা
হলো না। অনুনয় বিনয় করে তার পা-দুটোও
জড়িয়ে ধরে আকুতি জানিয়েছি।
বলবো কী, বিনিময়ে জুটলো সপাটে পায়ের
লাথি। রুক্ষ মাটিতে পড়ে তখন দূরে ছিটকে
গেছি। কেঁদেছি খুব।
পাথরে কপাল ঠুকে ফেটেছে। রক্তও অনর্গল
ঝরলো তার নাকের ডগায়। তবু হিমশৈলের
মতো তার পাথর-হৃদয়খানি সেসময় একটুও
গললো না।
জানো, মনে পড়ছে শৈশবের নানান ঘটনা।
যে ছোট বোনটি প্রায়শ মাঠে খেলে দৌড়ে
ছুটে এসে তার দাদার কাছে জুড়তো খুবই
ছোটখাটো আবদার, সেসব কখনো মেটাতে
পারিনি।
সে চোখের সামনে তিল তিল করে বেড়ে
উঠলো। তাকে পাত্রস্থ করার খুবই দরকার
ছিল। আজও সে কাজটি সুরাহা করা সম্ভব
হলো না।
মনে পড়ে, সে দিনের ঘটনা। চাকরী থেকে
অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ বাবা, মৃত্যুশয্যায়। আমাকে
ডেকে পাশে বসিয়ে হাত ধরেই বলেছিলেন
স্নেহাস্পর্শে, ‘বাবা! শোন, আমার উপার্জন
সব ফুরিয়ে গেল সংসার চালাতে আর তোর
ও ছোট বোনের শিক্ষার খরচে।
এখন আমি কপর্দক শূন্য, মাসমাইনে যেটুকু
পেনশন পাই সে আর কত? সে টাকায় এই
সংসার চালানো, সেও দুষ্কর।
আমার শরীরে ডায়াবেটিস সহ বেঁধেছে নানান
ব্যাধি। তোর মা? সেও ভুগছে এখন দুরারোগ্য
ক্যানসারে। সব চিকিৎসাই আজ বন্ধ টাকার
অভাবে।
সে কারণে তোর ছোট বোনকে আজও পাত্রস্থ
করতে পারিনি। দেখিস, চাকরী পেলে সুরাহা
করা যায় কিনা।
জানো, সে সময় দু’চোখ বেয়ে নিঃসাড়ে অশ্রু
ঝরলো। বেকারত্বের অব্যক্ত যন্ত্রণায় এ বুকটা
চিন চিন করলো। শরীরটা ঢলে পড়ার মতোই
অবস্থায়।
নিরুপায়, হাতটিকে ছাড়িয়ে নিয়েছি। তক্ষুণি
কোনো রকমে ছিটকে বেরিয়ে এসেছি সে ঘর
থেকে।
এসময় দেখো চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। খুবই
দ্বিধাগ্রস্ত, করবো কী? ইচ্ছা হয়, নিজের দুই
চোখ উপড়ে ফেলি যেন এ গ্রহণ আর দেখতে
না-হয়।
মাঝে মাঝে চাকরীর আশ্বাস বাণী শুনতে পাই।
যে যাই বলো, সে সব আজকাল আর ভালোও
লাগে না। ইচ্ছা হয়, নিজের কান গুলোতে যেন
গজাল পুঁতে দি’ যেন মস্তিষ্কে সে সব অনুভূত
না-হয়।
দেখেছি সাম্প্রতিককালে ক্ষতে প্রলেপের চেষ্টাও
কম হলো নাকি? সেখানে মলমের প্রলেপ দিলো
বটে, রোগ সারলো কৈ?
এখন, এক বঞ্চিত চাকরী-প্রার্থী হিসাবে প্রতিবাদ
জানানোর যেন সামর্থ্য টুকু হারিয়েছি। ইচ্ছা হয়
নিজের জিভ কেটে ফেলি যেন প্রতিবাদ শোনা
না-যায়।
শুনছি, কোকিল কুহু কুহু করে ডাকছে। মনে হয়
বসন্ত দিচ্ছে উঁকি? সে যেখানে থাকুক, এসময়
তাকে বলতেই ইচ্ছা হয় ‘দূর ছাই, তুই দিস না
উঁকিঝুঁকি। কী হবে যখন যৌবনও পৌঁছেছে শেষ
প্রান্তসীমায়? ’ অসহায়ের মতো বাইরের দিকেই
অপলক চেয়ে থাকি।
জানো দুঃখ হয়, যখন মনে পড়ে বিনা চিকিৎসায়
আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগে ভুগে বৃদ্ধ পিতামাতাও
আমাদেরও ছেড়ে চলে গেলেন।
আমার ও কিছু করার উপায় ছিল না।