কবি প্রসূন কাঞ্জিলাল -এর 'জঙ্গম' : নিজস্ব আবেগের আড়ালে লুকিয়ে আছে চর্চিত চয়ন


কবি প্রসূন কাঞ্জিলাল -এর নতুন কবিতার বই 'জঙ্গম' প্রকাশিত হয়েছে। আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করেছেন লিটল ম্যাগাজিন জগতের সুপরিচিত   ঋত্বিক ত্রিপাঠী । তখন রবীন্দ্র সদন চত্বরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার-এর তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের  লিটল ম্যাগ মেলা চলছিল। স্থাবর অপকৃষ্টি যখন নিত্যনতুন চেহারায় মননকে আচ্ছন্ন করে রাখার লক্ষ্যে, এই ভাঙাচোরা দিনকালে আরো সুচারু আগুয়ান, তখন 'জঙ্গম' তার অপনোদনে কোনো চেষ্টাই বাকি রাখবে না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় কৃশতনু এই কবিতার বইটির ৪৮টি পৃষ্ঠায়‌। মুখবন্ধ লিখেছেন কথাসাহিত্যিক ভগীরথ মিশ্র।
কবি প্রসূন কাঞ্জিলাল-এর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ *জঙ্গম* এর চল্লিশটি পাতা কবিতাপ্রিয় পাঠকের কাছে এক বর্ণময় অভিজ্ঞতার বাহক হয়ে ধরা দেয়। কবিতা তাঁর স্বাভাবিক যাপন, যদিও পাঠকসমাজে তিনি অধিক সমাদৃত একজন প্রাবন্ধিক হিসাবেই।


তাঁর কবিতায় শাশ্বত প্রশ্নে তিনি স্রষ্টাকে জিজ্ঞাসা করেন, কাঁটাতারের হাসিতে একটুও দুঃখ বাজে কি না। মানবিক এই প্রশ্নে আমরা বিভেদকামী মানসিকতাকে দ্বান্দ্বিক প্রশ্নবাণে ক্ষতবিক্ষত করার প্রয়াস দেখতে পাই। কবিকে চিন্তিত করে "তারকাটা মানুষের কালঘুম"। মাটির "কাদা হয়ে" যাওয়াও কবিকে চিন্তিত করে কারণ দৃঢ়তাকে আশ্রয় করেই কবিতার অগ্রগতি।


কবি ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, "লেখক হতে গেলে পাঠক হতে হয়, অনেক পড়তে হয়। না পড়ে কোনো উপায় নেই। প্রচুর পড়ার পরেই নিজস্ব ভাষা আবিষ্কার করা যায়। যদি ভাষা আবিষ্কার করা যায় তাহলেই লেখক হওয়া যায়, নাহলে যায় না। যারা না পড়ে ফাঁকি দিয়ে লেখক হতে চায়,তারা বেশিদূর যেতে পারবে না।" ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা শ্রী কাঞ্জিলাল-কে চেনেন, তাঁরা তাঁর গভীর পাঠাভ্যাস এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণার সাবলীল চর্চার নিষ্ঠা সম্পর্কে সম্যক অবহিত। কিন্তু কবিতার যে অক্ষর তাঁকে জঙ্গম যাপনে অভিষিক্ত করে, কবি-কে সেই শাশ্বত উত্তরণে নিজেকে সম্পৃক্ত করতেই হবে। সেই সাফল্যের খতিয়ান নথিভুক্ত হবে আগামীতে, প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় *'জঙ্গম*' সে মন্তব্য করতে সাহসী করে আমাদের।


স্পষ্ট উচ্চারণে কবি লিখেছেন-


আমায় বয়়ে নিয়়ে যায়
কবিতার প্লাবন।
জল সরে গেলে বুঝি,
কবিতা রেখে গেছে রসদ।
মনের জমিনে পলিমাটি স্তর,
আমি বিমূর্ত আবেগের
মূর্তি গড়়ে রাখি।।


পঙক্তিগুলিতে বানভাসি আবেগের অক্ষর উচ্চারণ করতে গিয়েও কবি নিজেকে কোথাও যেন গুটিয়ে নিয়েছেন। খুঁজে নিয়েছেন নিজস্ব সৃষ্টির এক আবডাল। কবিতার রসদ আস্বাদনে তিনি তৃপ্ত জাগরুক; তাই তাঁর পাঠক তাঁর মনের জমিন খুঁড়ে হয়তো পাবেন না তাঁর মানসিকতার আন্দাজ।


তিনি নিজের আবেগ-কে বিমূর্ত বিশেষণ দিলেও, কবিতার প্লাবন শেষে স্রোতস্বিনী আবেগের  জল সরে যাওয়া সম্পর্কে নিঃসন্দিহান তাঁকে হতে দেয়নি যে ভাবনা, সে ভাবনা হয়তো 'বিমূর্ত' আবেগের অনুসারী নয়। অনুভবের উদ্গত অশ্রু, সৃজনের প্লাবন শেষে তাঁকে কি সত্যই কোনো মূর্তি গড়ার সুযোগ দেবে ? নিশ্চিত হতে পারি না পাঠক হিসাবে।


অনুভবী কবি যাপনের অপর চিত্রায়ণে ঘোষণা করেছেন-


শুধু কিছু রোদে পোড়া দেয়ালের রং,
গভীর ছবির বিমূর্ততায় --
প্রণালী প্রয়াসের ধাঁধা খেলে।
ভুল করে পাশ ফিরে
চায় সুখ ।
ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়়ে
আওড়়ায় --


কবির মনের ঘরে যে দৃঢ় দেওয়াল  নির্মাণ করেছেন, তাকে তপ্ত করে আবেগের রৌদ্র, ধ্বংসের ঝড়জলে যাতে টিঁকে যায় মননের ভিত। চেতনার বর্ণে সেই দেওয়ালের রং উজ্জ্বল হতে পেরেছে কি না সে বিচার সামগ্রিকভাবে থাকে পাঠকেরই হাতে।
তবে বাস্তবের আতপে দগ্ধ প্রাচীর তার বর্ণময়তায় আবিল যে প্রতিচিত্রে ছন্দোবদ্ধ প্রণালী-শৃঙ্খলা রচনা করতে চায়, কবির সুচারু পঙক্তি-বিন্যাসে সেই প্রচেষ্টা শেষমেশ সাফল্য পাবেই। এ সময় অলস বিমুখতা যে নিতান্তই বেমানান- সে কথা কবির মনোভূমিতে সৃষ্ট বর্ণময় ও গভীর ছবির স্মরণে থাকবেই, এ আশ্বাস তাঁর উচ্চারণকে সমৃদ্ধ করেছে তা সংক্ষিপ্ত অনুভবেও প্রতীয়মান।


মধ্যগতিতে বহমান কবির জীবন-গঙ্গা। তিনি উপলব্ধি করেছেন,


এ বয়সে আর কারও সঙ্গে মিটবে না।
কারও সঙ্গে বনবে না
নতুন কিছু.......


এই পঙক্তি নিজের প্রতি অভিভাবন না বহমান জীবনের শাশ্বত উপলব্ধির উচ্চারণ, সুগভীর অনুভবী মননে জারিত বিশ্লেষণ ছাড়া সে সিদ্ধান্তে কেউই পৌঁছাতে চাইবেন না, যদিও কবি কালক্ষেপ না করে দ্রুত তাঁর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন:


ক্ষমা চাওয়ার লোভ,
ক্ষমা করার কারণ-
পথের দু
'দিকে ফেলে রেখে
তাই এগিয়ে চলি এবার।


এই সিদ্ধান্ত কিন্তু গতিবাদ বা মুক্তিবাদের প্রেক্ষিতে অনুপ্রাণিত কোনো বিকল্প চয়ন নয়, এ হলো একধরণের পবিত্র নির্লিপ্ততা, যার সন্ধান ঋজু-কলেবর কাব্যগ্রন্থটিতে বারবার পাই আমরা।


কবি আত্মপরিচয় প্রদানে মগ্ন থেকে কেবলমাত্র  নিজস্ব ধারণা ও সিদ্ধান্তকেই অমৃতসমান জ্ঞানে পাঠক ও সাধারণের মধ্যে বিতরণ করাকে কর্তব্যজ্ঞান করেন নি। বরং প্রকৃত কবিসত্তার আগ্রহী উন্মোচনে বারংবার অকপট থাকতে চেয়েছেন।


কবির নজরে কবির মনন প্রতিফলিত হয়েছে। কবি যে  আড়াল চেনেন তা কি সর্বদা নির্জনতার সন্ধানী ? না কি সেই আড়ালে তিনি সংগ্রহ করতে চান আসন্ন বিস্ফোরণের রসদ? শ্রী কাঞ্জিলালের সুচারু ব্যাখ্যায় যে কারণেই ঘটমান সাময়িকতা কবির পদক্ষেপে বদল এনে থাকুক না কেন, সে কারণ কবির 'একান্ত নিজস্ব'। আমরা মনে করি, এই একান্ত নিজস্বতাই তো একজন স্রষ্টাকে কবি হতে প্ররোচিত করে। "স্বভাব ও অনুভূতি"-র বেশে কবির নিজস্ব আবেগ আনতে পারে সেই বাঞ্ছিত পরিবর্তন, যার স্পন্দন কবির বুকে বিপ্লব হয়ে বাজে। অবিমিশ্র চেতনার পরম আঘাতে ঋদ্ধ হয়েছে এ বৈপ্লবিক অনুভূতির অনুরণনেরা। তার পরিকল্পিত গোপন ধাত্রে লালিত হয়ে কবির জীবন ও সৃষ্টির রহস্য মিশে যায় অমরত্বের সম্ভাবনায়। কবি লিখে চলেন:-


কবি আড়়াল চেনেন।
একান্ত নিজস্ব কারণেই
নিজের মধ্যে বদল
এসে গেছে।
স্বভাব ও অনুভূতি
বিপ্লব এনেছে
গোপনে দিনের পর দিন।
রহস্য মিশে যায় সম্ভাবনায়।


আজ সেই উজ্জ্বল সম্ভাবনার বিভায় কবিতার জগত মুখরিত। জীবনের যাবতীয় রহস্যের উন্মোচনকল্পে চলমান থাক কবি প্রসূনের "জঙ্গম" সৃজন।।