আনন্দবাজার পত্রিকা আটের দশকে তাঁর সম্পর্কে লিখেছিল, " সন্দীপ দত্ত বাংলা সাহিত্যের বীজতলা নির্মাণে ব্রতী রয়েছেন"।  তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম শিবনাথ শাস্ত্রীর তৈরী সিটি কলেজ স্কুলে। স্যার অষ্টম শ্রেণিতে আমাদের বাংলাৎ নিতেন। ১৯৮৯-৯০ শিক্ষাবর্ষে স্যারের অনুপ্রেরণায় সুমন দত্তগুপ্তের সম্পাদনায় বেরোয় আমাদের ক্লাসের দেওয়াল পত্রিকা। উদ্বোধন করেছিলেন বিদ্যালয়ের সহ-প্রধানশিক্ষক যামিনীবাবু স্যার। এটুকু মনে আছে, তখন " কলকাতা ৩০০ " বিষয়ের উপর বেশ লেখালেখি হচ্ছিল। বানানো গল্প অনুযায়ী ১৬৮৯ এ জোব চার্ণক কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোন গল্প মিথ্যা আর কোন গল্প গ্রহণযোগ্য সেই পাঠ সন্দীপ দত্ত স্যার-এর কাছ থেকেই পাওয়া। শুধু দেওয়াল পত্রিকা নয়। সিটি কলেজ স্কুলের মনোনীত অভিভাবক প্রতিনিধি, আমার পিতার বারংবার অনুরোধে বিদ্যালয় পরিচালন সমিতি ১৯৯১ সালে  সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য হয় যে বিদ্যালয়ের বাৎসরিক ছাপানো পত্রিকা বেরোবে। সন্দীপ দত্ত স্যারের সম্পাদনায় এরপর থেকে সেই "সিটি কলেজ স্কুল পত্রিকা" বেরোতে থাকে। নিছক স্কুল ম্যাগাজিন নয়, এই বার্ষিক সংকলনগুলি সংগ্রহযোগ্য সাহিত্যপত্র হিসাবে গণ্য হতে পারে, এতটাই সুসম্পাদিত।


অবশ্য পত্রিকার ভালো মান স্কুলটিকে ছাত্রশূন্য হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারে নি। মৃণালকান্তি মুখোপাধ্যায়-এর মতো শিক্ষক, যিনি আকাশবাণীতে ছাত্রদের নিয়ে "বিদ্যার্থীদের জন্য " অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন-বিদ্যালয়কে নানা ব্যাপারে শহরের সেরা করার স্বপ্ন দেখতেন-কানাইবাবু, অবনীবাবু, সুজিতবাবু- যাঁরা সবধরণের ছাত্রদের কাছে পিতৃস্নেহের প্রতিশব্দ ছিলেন, এনারা বিদায় নেবার পর থেকে বিদ্যালয়টির একটু একটু করে উঠে যাওয়া সুনিশ্চিত হয়।


অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন-ই একটি ছোট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করব- এই আর্জি নিয়ে আমরা ক্লাস  সেভেনের ছেলেরা তখনকার  প্রধানশিক্ষক পশুপতি দাস মহাশয়ের কাছে যাই। কিন্তু কিশোরদের সে উদ্যমকে ফিল্টার উইলস সিগারেটের ধোঁয়ায় নস্যাৎ করে দিয়ে পশুবাবু বলেছিলেন:- 'ন্যা,ন্যা- এই স্কুলে ওসব হয় না'।


আমাদের স্কুল যেহেতু ব্রাহ্ম সোসাইটির রুলে চলত- ওখানে ব্রাহ্ম ছাড়া প্রধানশিক্ষক হওয়া যায় না। পশুপতিবাবু ছিলেন শেষ প্রধানশিক্ষক। তাই ১৯৯২ সালে শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্তি ও স্বস্তি দিয়ে তিনি অবসর নেবার পর থেকে পরবর্তী ৩১ বছরে আর কোনো প্রধানশিক্ষক ওই স্কুলে আসেন নি।


স্যারের পড়ানো কিছু কথা শুধু আমার নয়, সমস্ত বন্ধু এমনকি পরের ব্যাচের ভাইদেরও মনে আছে।


১." সমাস/শিখতে লাগে ছ-মাস।"


২. "রাত হল, ভাত দাও"। এটা মানিক বন্দোপাধ্যায় তাঁর বউদিদিকে ভাত চাওয়ার সময় বলতেন। এর থেকে নাকি ভবিষ্যতে যে তিনি( মানিক) লেখালেখির দিকে যাবেন- এটা বোঝা যেত (স্যারের মতে)।


১৯৮৯ সালে অষ্টম শ্রেণিতে আমাদের ক্লাসের সব ছাত্রকে পুজোর ছুটি পড়ার দিন  তিনি বলেছিলেন - আমাকে চিঠি লিখবি। আমি উত্তর দেব। আমি দোনোমোনো ভাব করে পোষ্টকার্ডে একটি চিঠি স্যারকে পাঠাই। অবাক করে দিয়ে স্কুল খোলার আগেই উত্তর পাঠিয়ে দেন স্যার। পোষ্টকার্ডে আসা সেই স্যারের চিঠি- একটা কিশোরের মনে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারে - পরে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের আলোয় বুঝতে পারি।  পত্রলিখন শেখানোর এ ব্যবহারিক ক্লাসের আইডিয়া বিরল বলেই আমার ধারণা।


সন্দীপ দত্ত স্যার আমাদের শুধু বাংলা সাহিত্য পড়ান‌ নি। অষ্টম শ্রেণির ওইটুকু সময়ের মধ্যে পড়িয়ে দিয়েছিলেন সমাজ চেনার কিছু পাঠ-ও। লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাগার আর আমার ব্যবহার করা হয় নি। নিজেকে আমিও লিটল ম্যাগ কর্মী বলি, কিন্তু সেটা বিলাসিতা- বড়জোর শখ হতে পারে। লিটল ম্যাগের লড়াই কখনো সাধনা- কখনো গেরিলা যুদ্ধ- কখনো আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে অন্ধকার রাতে একলা সাগরে ডিঙ্গা ভাসানো, পূবের আকাশ কখন রাঙ্গা হবে সেই প্রত্যাশায়।


"বই দগ্ধ হয় না .. বৈদগ্ধ বাড়ায়" । নয়ের দশকের শেষদিকে একবছর কলকাতা বইমেলায় আগুন লাগার পরে ক্লাসে এসে বলেছিলেন । অবশ্য আমাদের ক্লাসে নয়। জুনিয়র ভাইদের ক্লাসে।


শাসকের বড়ো সমস্যা সন্দীপ দত্ত স্যারের মতো নিরীহ শিক্ষকদের নিয়ে। কখনো রাজনৈতিক বক্তব্য ছাত্রদের সামনে রাখতে দেখি নি। বড়জোর রাস্তায় দেখা হলে পুরোনো ছাত্রদের বলতে শুনেছি- "পার্টিবাজি করছিস কর- কিন্তু পড়াশুনোটাও করিস"। মুশকিল হলো, সরকারের পুলিশ যখন "মাত্র" খানপনেরো লোককে গুলি করে মেরে ফেলার সাথে সামান্য এই হাজারখানেক মতো লোককে নদীর চরে পুঁতে দেয় বা নদীর জলে ভাসিয়ে শিল্প আর গণতন্ত্রকে বাঁচানোর বৈপ্লবিক দায়িত্বটা পালন করে- তখন নিরীহ সন্দীপ দত্ত স্যারেরা আর ঘরে বসে থাকেন না। হয়তো বইমেলায় হালকা মেজাজে বসে আছেন- আর হাতে ধরা পোষ্টারে দাউদাউ করে জ্বলছে কৃষকহত্যার বিরুদ্ধে লেখা স্লোগান - বা কেবল লেখা আছে -- " রাজা, তোর কাপড় কোথায়" ?


এ প্রশ্ন যেকোনো সময়, যে কোনো রাজাকেই ছুঁড়ে দিতে পারেন সন্দীপ দত্ত - তাই হয়তো বিভূষিত হওয়া হয়ে ওঠে না-কপালে ওঠে না ক্ষমতার জয়তিলক-ঝুঁকিপূর্ণ সেই বিদূষক-এর মতো যখন তখন বলে দিতেই পারেন, "তবে আমায় বিদায় দিন মহারাজ- এ রাজ্যে থাকলে আমি হাসতে ভুলে যাব"।


সন্দীপ দত্ত স্যার একমাত্র শিক্ষক স্কুলজীবনের- যাঁর বাড়ির ঠিকানা অনেক ছাত্রেরই মুখস্থ। ১৮এম টেমার লেন। কলকাতা ৯। ঠিকানাটিকে আন্তর্জাতিক করেছেন বহু আগেই। বিশ্বের সমকালীন সাহিত্যের বহু দিকপাল স্যারের সাহিত্যসংগ্রামের সহকর্মী ছিলেন। বহু লোক, বহু দিকের লোক  স্যারের সম্পর্কে দীর্ঘ আলাপচারিতা ও আলোচনার শেষে সখেদে বলেছেন-- ইয়ে, মানে উনি বোধহয় ঠিক "আমাদের" নয়। সাহিত্য-শিল্পে যুক্ত মানুষের এই অবস্থান হওয়াই বাঞ্ছনীয় বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত।


যেভাবে ছাত্র কমে গেছে আর অল্পদিনেই আমাদের সিটি স্কুল ইতিহাসের পাতায় চলে যাবে। স্যারেরাও এক এক করে চলে যাচ্ছেন। আমরা প্রাক্তন ছাত্ররা অবশ্য জীবনের সিলেবাসটা গোটা কমপ্লিট না হওয়া পর্যন্ত আমাদের স্মৃতিকথা পরবর্তী প্রজন্মকে শোনাবো। সেই স্মৃতিকথার অন্যতম চরিত্র হিসাবে উজ্জ্বল থাকুন আমাদের প্রিয় স্যার সন্দীপ দত্ত ।


১৩ মার্চ ,২০২৩ না ফেরার দেশে চলে গেছেন স্যার। আহ্বান-এর একটা করে সংখ্যা বের করে দেখা করতে যেতাম। ১৩ মার্চ, ২০২৩ স্যারকে জানি না কেন দেখতে যেতে পারলাম না। প্রণাম করার সময় পা ছুঁতে পারলাম না। ক্ষমা করবেন স্যার। স্বীয় প্রতিভায় ভাস্বর নক্ষত্র ছিলেন আপনি- তারাদের দেশে আপনার যথার্থ মূল্যায়ন হবে- এ আমার ধারণা ও বিশ্বাস।


২০২৪-এর কলকাতার আন্তর্জাতিক বইমেলাতে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের নাম দেওয়া হয়েছে আমার স্যার সন্দীপ দত্ত-র নামে। আমি গর্বিত, আমি অষ্টম শ্রেণিতে টানা এক বছর স্যারের ক্লাসে, স্যারের কাছে বাংলা পড়েছি।