তিনটে কাঁচা আম পড়ে ছিল গাছতলায়
                       চৈত্রমাসের সকালে মৃদু রোদ্‌দুরে ।
               যখন-দেখলুম অস্থির ব্যগ্রতায়
                           হাত গেল না কুড়িয়ে নিতে ।
                   তখন চা খেতে খেতে মনে ভাবলুম ,
                          বদল হয়েছে পালের হাওয়া
                   পুব দিকের খেয়ার ঘাট ঝাপসা হয়ে এলে ।
           সেদিন গেছে যেদিন দৈবে-পাওয়া দুটি-একটি কাঁচা আম
                           ছিল আমার সোনার চাবি ,
                       খুলে দিত সমস্ত দিনের খুশির গোপন কুঠুরি ;
                          আজ সে তালা নেই , চাবিও লাগে না ।


  
                   গোড়াকার কথাটা বলি ।
           আমার বয়সে এ বাড়িতে যেদিন প্রথম আসছে বউ
                        পরের ঘর থেকে ,
           সেদিন যে-মনটা ছিল নোঙর-ফেলা নৌকো
               বান ডেকে তাকে দিলে তোলপাড় করে ।
                   জীবনের বাঁধা বরাদ্দ ছাপিয়ে দিয়ে
                       এল অদৃষ্টের বদান্যতা ।
               পুরোনো ছেঁড়া আটপৌরে দিনরাত্রিগুলো
                        খসে পড়ল সমস্ত বাড়িটা থেকে ।
               কদিন তিনবেলা রোশনচৌকিতে
                       চার দিকের প্রাত্যহিক ভাষা দিল বদলিয়ে ;
                                ঘরে ঘরে চলল আলোর গোলমাল
                                        ঝাড়ে লণ্ঠনে ।
                       অত্যন্ত পরিচিতের মাঝখানে
                                ফুটে উঠল অত্যন্ত আশ্চর্য ।
                       কে এল রঙিন সাজে সজ্জায় ,
                                আলতা-পরা পায়ে পায়ে —
           ইঙ্গিত করল যে , সে এই সংসারের পরিমিত দামের মানুষ নয় —
সেদিন সে ছিল একলা অতুলনীয় ।
                           বালকের দৃষ্টিতে এই প্রথম প্রকাশ পেল —
           জগতে এমন কিছু যাকে দেখা যায় কিন্তু জানা যায় না ।
                          বাঁশি থামল , বাণী থামল না —
                                 আমাদের বধূ রইল
                         বিস্ময়ের অদৃশ্য রশ্মি দিয়ে ঘেরা ।


  
           তার ভাব , তার আড়ি , তার খেলাধুলো ননদের সঙ্গে ।
               অনেক সংকোচে অল্প একটু কাছে যেতে চাই ,
                       তার ডুরে শাড়িটি মনে ঘুরিয়ে দেয় আবর্ত ;
                কিন্তু , ভ্রূকুটিতে বুঝতে দেরি হয় না , আমি ছেলেমানুষ ,
                   আমি মেয়ে নই , আমি অন্য জাতের ।
               তার বয়স আমার চেয়ে দুই-এক মাসের
                       বড়োই হবে বা ছোটোই হবে ।
                   তা হোক , কিন্তু এ কথা মানি ,
                           আমরা ভিন্ন মসলায় তৈরি ।
               মন একান্তই চাইত , ওকে কিছু একটা দিয়ে
                          সাঁকো বানিয়ে নিতে ।
               একদিন এই হতভাগা কোথা থেকে পেল
                          কতকগুলো রঙিন পুথি ;
                   ভাবলে , চমক লাগিয়ে দেবে ।
                          হেসে উঠল সে ; বলল ,
                                “ এগুলো নিয়ে করব কী । ”
               ইতিহাসের উপেক্ষিত এই-সব ট্র্যাজেডি
                       কোথাও দরদ পায় না ,
               লজ্জার ভারে বালকের সমস্ত দিনরাত্রির
                        দেয় মাথা হেঁট করে ।
           কোন্‌ বিচারক বিচার করবে যে , মূল্য আছে
                               সেই পুঁথিগুলোর ।


  
                   তবু এরই মধ্যে দেখা গেল , শস্তা খাজনা চলে
                       এমন দাবিও আছে ওই উচ্চাসনার —
সেখানে ওর পিড়ে পাতা মাটির কাছে ।
                          ও ভালোবাসে কাঁচা আম খেতে
                       শুল্পো শাক আর লঙ্কা দিয়ে মিশিয়ে ।
           প্রসাদলাভের একটি ছোট্ট দরজা খোলা আছে
                আমার মতো ছেলে আর ছেলেমানুষের জন্যেও ।


  
                        গাছে চড়তে ছিল কড়া নিষেধ ।
                          হাওয়া দিলেই ছুটে যেতুম বাগানে ,
                       দৈবে যদি পাওয়া যেত একটিমাত্র ফল
                          একটুখানি দুর্লভতার আড়াল থেকে ,
                       দেখতুম , সে কী শ্যামল , কী নিটোল , কী সুন্দর ,
                          প্রকৃতির সে কী আশ্চর্য দান ।
                       যে লোভী চিরে চিরে ওকে খায়
                          সে দেখতে পায় নি ওর অপরূপ রূপ ।


           একদিন শিলবৃষ্টির মধ্যে আম কুড়িয়ে এনেছিলুম ;
               ও বলল , “ কে বলেছে তোমাকে আনতে । ”
                       আমি বললুম , “ কেউ না । ”
                   ঝুড়িসুদ্ধ মাটিতে ফেলে চলে গেলুম ।
           আর-একদিন মৌমাছিতে আমাকে দিলে কামড়ে ;
                   সে বললে , “ এমন করে ফল আনতে হবে না । ”
                          চুপ করে রইলুম ।
  
                                বয়স বেড়ে গেল ।
           একদিন সোনার আংটি পেয়েছিলুম ওর কাছ থেকে ;
               তাতে স্মরণীয় কিছু লেখাও ছিল ।
           স্নান করতে সেটা পড়ে গেল গঙ্গার জলে —
                   খুঁজে পাই নি ।
           এখনো কাঁচা আম পড়ছে খসে খসে
               গাছের তলায় , বছরের পর বছর ।
                   ওকে আর খুঁজে পাবার পথ নেই ।