১
বিস্তারিয়া ঊর্মিমালা ,
বিধির মানস-বালা ,
মানস-সরসী ওই নাচিছে হরষে ।
প্রদীপ্ত তুষাররাশি ,
শুভ্র বিভা পরকাশি ,
ঘুমাইছে স্তব্ধভাবে হিমাদ্রি উরসে ।
২
অদূরেতে দেখা যায় ,
উজল রজত কায় ,
গোমুখী হইতে গঙ্গা ওই বহে যায় ।
ঢালিয়া পবিত্র ধারা ,
ভূমি করি উরবরা ,
চঞ্চল চরণে সতী সিন্ধুপানে ধায় ।
৩
ফুটেছে কনকপদ্ম অরুণ কিরণে ।।
অমল সরসী - ' পরে ,
কমল , তরঙ্গভরে ,
ঢুলে ঢুলে পড়ে জলে প্রভাত পবনে ।
৪
হেলিয়া নলিনীদলে ,
প্রকৃতি কৌতুকে দোলে ,
সরসী-লহরী ধায় ধুইয়া চরণ ।
ধীরে ধীরে বায়ু আসি ,
দুলায়ে অলকরাশি ,
কবরী-কুসুম-গন্ধ করিছে হরণ ।
৫
বিজনে খুলিয়া প্রাণ ,
নিখাদে চড়ায়ে তান ,
শোভনা প্রকৃতিদেবী গান ধীরে ধীরে ।
নলিন নয়নদ্বয় ,
প্রশান্ত বিষাদময় ,
ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস বহিল গভীরে ।
৬
‘ অভাগী ভারত! হায় , জানিতাম যদি ,
বিধবা হইবি শেষে ,
তা হলে কি এত ক্লেশে ,
তোর তরে অলংকার করি নিরমাণ ?
তা হলে কি পূতধারা মন্দাকিনী নদী
তোর উপত্যকা - ' পরে হত বহমান ?
তা হলে কি হিমালয় ,
গর্বে ভরা হিমালয়
দাঁড়াইয়া তোর পাশে
পৃথিবীরে উপহাসে ,
তুষারমুকুট শিরে করি পরিধান ।
৭
তা হলে কি শতদলে ,
তোর সরোবরজলে ,
হাসিত অমন শোভা করিয়া বিকাশ ?
কাননে কুসুমরাশি ,
বিকাশি মধুর হাসি ,
প্রদান করিত কি লো অমন সুবাস ?
৮
তা হলে ভারত! তোরে ,
সৃজিতাম মরু করে ,
তরুলতা-জন-শূন্য প্রান্তর ভীষণ ;
প্রজ্বলন্ত দিবাকর ,
বর্ষিত জ্বলন্ত কর ,
মরীচিকা পান্থদের করিত ছলন! '
থামিল প্রকৃতি করি অশ্রু বরিষন ।
৯
গলিল তুষারমালা ,
তরুণী সরসী বালা ,
ফেনিল নীহার-নীর সরসীর জলে ।
কাঁপিল পাদপদল ;
উথলে গঙ্গার জল ,
তরুস্কন্ধ ছাড়ি লতা লুটিল ভূতলে ।
১০
ঈষৎ আঁধাররাশি ,
গোমু্খী শিখর গ্রাসী ,
আটক করিয়া দিল অরুণের কর ।
মেঘরাশি উপজিয়া ,
আঁধারে প্রশ্রয় দিয়া ,
ঢাকিয়া ফেলিল ক্রমে পর্বতশিখর ।
১১
আবার ধরিয়া ধীরে সুমধুর তান ।
প্রকৃতি বিষাদে দুঃখে আরম্ভিল গান ।
‘ কাঁদ্! কাঁদ্! আরো কাঁদ্ অভাগী ভারত
হায়! দুঃখ-নিশা তোর ,
হল না হল না ভোর ,
হাসিবার দিন তোর হল না আগত ?
১২
লজ্জাহীনা! কেন আর ,
ফেলে দে-না অলংকার ,
প্রশান্ত গভীর ওই সাগরের তলে ?
পূতধারা মন্দাকিনী ,
ছাড়িয়া মরতভূমি
আবদ্ধ হউক পুনঃ ব্রহ্ম-কমণ্ডলে ।
১৩
উচ্চশির হিমালয় ,
প্রলয়ে পাউক লয় ,
চিরকাল দেখেছে যে ভারতের গতি ।
কাঁদ্ তুই তার পরে ,
অসহ্য বিষাদভরে ,
অতীত কালের চিত্র দেখাউক স্মৃতি ।
১৪
দেখ্ , আর্য সিংহাসনে ,
স্বাধীন নৃপতিগণে ,
স্মৃতির আলেখ্যপটে রহেছে চিত্রিত ।
দেখ্ দেখি তপোবনে ,
ঋষিরা স্বাধীন মনে ,
কেমন ঈশ্বরধ্যানে রহেছে ব্যাপৃত ।
১৫
কেমন স্বাধীন মনে ,
গাহিছে বিহঙ্গগনে ,
স্বাধীন শোভায় শোভে প্রসূননিকর ।
সূর্য উঠি প্রাতঃকালে ,
তাড়ায় আঁধারজালে ,
কেমন স্বাধীনভাবে বিস্তারিয়া কর!
১৬
তখন কি মনে পড়ে —
ভারতী-মানস-সরে ,
কেমন মধুর স্বরে বীণা ঝংকারিত!
শুনিয়ে ভারত-পাখি
গাহিত শাখায় থাকি
আকাশ পাতাল পৃথ্বী করিয়া মোহিত ?
১৭
সে-সব স্মরণ করে , কাঁদ লো আবার ।
‘ আয় রে প্রলয় ঝড়
গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর
ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার!
স্বর্গমর্ত্য রসাতল হোক একাকার ।
১৮
প্রভঞ্জন ভীম-বল!
খুলে দাও , বায়ুদল!
ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাক ভারতের বেশ ।
ভারতসাগর রুষি
উগরো বালুকারাশি
মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ ।
১৯
বলিতে নারিল আর প্রকৃতি-সুন্দরী ।
ধ্বনিয়া আকাশভূমি ,
গরজিল প্রতিধ্বনি ,
কাঁপিয়া উঠিল বেগে ক্ষুব্ধ হিমগিরি ।
২০
জাহ্নবী উন্মত্তপারা ,
নির্ঝর চঞ্চল ধারা ,
বহিল প্রচন্ডবেগে ভেদিয়া প্রস্তর ।
মানস সরস-পরে ,
পদ্ম কাঁপে থরে থরে
দুলিল প্রকৃতি সতী আসন-উপর ।
২১
সুচঞ্চল সমীরণে ,
উড়াইল মেঘগণে ,
সুতীব্র রবির ছটা হল বিকীরিত
আবার প্রকৃতি সতী আরম্ভিল গীত ।
২২
‘ দেখিয়াছি তোর আমি সেই এক বেশ ,
অজ্ঞাত আছিল যবে মানবনয়নে ।
নিবিড় অরণ্য ছিল এ বিস্তৃত দেশ ,
বিজন ছায়ায় নিদ্রা যেত পশুগণে ,
কুমারী অবস্থা তোর সে কি পড়ে মনে ?
সম্পদ বিপদ সুখ ,
হরষ বিষাদ দুখ ,
কিছুই না জানিতিস্ সে কি পড়ে মনে ?
সে-এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ ,
যখন মানবগণ ,
করে নাই নিরীক্ষণ ,
তোর সেই সুদুর্গম অরণ্যপ্রদেশ ।
না বিতরি গন্ধ হায় ,
মানবের নাসিকায়
বিজনে অরণ্যফুল , যাইত শুকায়ে
তপনকিরণ-তপ্ত মধ্যাহ্নের বায়ে ।
সে এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ ।
২৩
সেইরূপ রহিল না কেন চিরকাল!
না দেখি মনুষ্যমুখ
না জানিয়া দুঃখসুখ
না করিয়া অনুভব মান অপমান ।
অজ্ঞান শিশুর মত
আনন্দে দিবস যেত ,
সংসারের গোলমালে থাকিয়া অজ্ঞান ।
তা হলে তো ঘটিত না এ-সব জঞ্জাল!
সেইরূপ রহিলি না কেন চিরকাল ?
সৌভাগ্যে হানিল বাজ ,
তা হলে তো তোরে আজ
অনাথা ভিখারীবেশে কাঁদিতে হত না ?
পদাঘাতে উপহাসে ,
তা হলে তো কারাবাসে
সহিতে হত না শেষে এ ঘোর যাতনা ।
২৪
অরণ্যেতে নিরিবিলি ,
সে যে তুই ভালো ছিলি ,
কী কুক্ষণে করিলি রে সুখের কামনা ।
দেখি মরীচিকা হায়!
আনন্দে বিহ্বলপ্রায়!
না জানি নৈরাশ্য শেষে করিবে তাড়না ।
২৫
আইল হিন্দুরা শেষে ,
তোর এ বিজন দেশে ,
নগরেতে পরিণত হল তোর বন ।
হরিষে প্রফুল্লমুখে ,
হাসিলি সরলা! সুখে ,
আশার দর্পণে মুখ দেখিলি আপন ।
২৬
ঋষিগণ সমস্বরে
অই সামগান করে
চমকি উঠিছে আহা! হিমালয় গিরি ।
ওদিকে ধনুর ধ্বনি ,
কাঁপায় অরণ্যভূমি
নিদ্রাগত মৃগগণে চমকিত করি ।
সরস্বতী-নদীকূলে ,
কবিরা হৃদয় খুলে
গাইছে হরষে আহা সুমধুর গীত ।
বীণাপাণি কুতূহলে ,
মানসের শতদলে
গাহেন সরসী বারি করি উথলিত ।
২৭
সেই এক অভিনব
মধুর সৌন্দর্য তব ,
আজিও অঙ্কিত তাহা রয়েছে মানসে ।
আঁধার সাগরতলে
একটি রতন জ্বলে
একটি নক্ষত্র শোভে মেঘান্ধ আকাশে ।
সুবিস্তৃত অন্ধকূপে ,
একটি প্রদীপ-রূপে
জ্বলিতিস তুই আহা ,
নাহি পড়ে মনে ?
কে নিভালে সেই ভাতি ভারতে আঁধার রাতি
হাতড়ি বেড়ায় আজি সেই হিন্দুগণে ।
সেই অমানিশা তোর ,
আর কি হবে না ভোর
কাঁদিবি কি চিরকাল ঘোর অন্ধকূপে ।
অনন্ত কালের মতো ,
সুখসূর্য অস্তগত ,
ভাগ্য কি অনন্ত কাল রবে এই রূপে ।
তোর ভাগ্যচক্র শেষে ,
থামিল কি হেথা এসে ,
বিধাতার নিয়মের করি ব্যভিচার
আয় রে প্রলয় ঝড় ,
গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর
ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার ।
প্রভঞ্জন ভীমবল ,
খুলে দেও বায়ুদল ,
ছিন্ন ভিন্ন করে দিক ভারতের বেশ ।
ভারতসাগর রুষি ,
উগরো বালুকারাশি
মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ ।