যাদের লেখক হওয়ার বাসনা তাদের বোধ করি একটাই প্রেরণা — তা হলো সম্মান পাওয়ার অবারিত সম্ভাবনা। সম্মান পাওয়ার ক্ষেত্রটা ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু সম্মানের বিষয়টা অভিন্ন। সম্মান পাওয়ার স্বপ্নের পরিধির সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, কিন্তু সম্মান পাওয়ার আকাংখার জায়গাটা স্থির। আজকাল কেউ কেউ অবশ্য দাবি করেন যে, সম্মানীর জন্য লিখেন। তাদেরকে বলি, আগেতো সম্মান, তারপর সম্মানীর প্রশ্ন। সম্মান না থাকলে সম্মানীর প্রশ্ন অবান্তর। সম্মান অর্জন করতে পারলে সম্মানীটা এমনিতেই আসবে। বাস্তবিক অর্থে কোন সাহিত্যিকই সম্মানীর জন্য লেখালেখি শুরু করেননি, করেছেন সম্মানের জন্য। তাহলে লেখক সম্মানী নিয়ে আলোচনার অবতারণা কেন?


আসলে বিষয়টি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সম্প্রতি ফেসবুকে কিছু স্ট্যাটাস এবং আলোচনা দেখে। কয়েকদিন আগে একটি ছোট কাগজের ফেসবুক পেইজে তাদের পরবর্তী সংখ্যার জন্য লেখা আহবান করে একটি স্ট্যাটাস দেয়া হলে একজন জিজ্ঞেস করলোঃ "আপনাদের পত্রিকায় লেখার জন্য কোন সম্মানী দেয়া হয়?" পত্রিকার তরফ থেকে বলা হলোঃ "সম্মানী দেয়া হয়না, তবে সম্মান দেয়া হয়।" প্রশ্নকর্তা তার প্রতিউত্তরে যা বললেন তা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তার সাথে আরও কয়েকজন সুর মেলালেন প্রায় অভিন্ন ভাষায়। একজন লেখকের প্রতিক্রিয়া এমন হতে পারে! তাও আবার লেখক সম্মানী নিয়ে!!


এটি যে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা তা নয়। প্রায়ই অনেক লেখকের কাছ থেকে ফেসবুকে এমন প্রতিক্রিয়া মাঝে মধ্যেই দেখছি। এর পেছনে প্রকৃত কারণটা আসলে কী তা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। কারণ আমাদের দেশের কোন পত্রিকা কতটা সম্মানী দেয় আর কোন মাপের লেখকদের দেয় তা মোটামুটি ভালোই জানা আছে আমার। ঐটুকু সম্মানী পাবার আশায় কোন লেখক লিখেন বলে আমি বিশ্বাস করি না। তাহলে সম্মানী নিয়ে এতো কথা কেন?


নিজের যতসামান্য লেখালেখির অভ্যাস থেকে জানি একটি লেখা প্রকাশে একজন লেখকের যে কি আনন্দ, সেই তুলনায় লেখক সম্মানী অতি তুচ্ছ ব্যাপার। পত্রিকার পাতায় একটি লেখা প্রকাশের জন্য এক একজন লেখক যে এই পত্রিকা থেকে সেই পত্রিকা অফিসে কতো ঘুরে বেড়ান তা আর এখানে উল্লেখ না-ই করলাম। কিন্তু একটি কথা না বলে পারছিনা। প্রতি বছর অমর একুশের বইমেলায় যে বিপুল সংখ্যক লেখকের বই বের হয় তার কয়টা প্রকাশকের টাকায় আর কয়টা লেখকের নিজের গাটের টাকায় বের হয় তা কারোই অজানা নয়। এই প্রসঙ্গে একজ সুপ্রতিষ্ঠিত কবির মাস পাঁচেক আগের ফেসবুক স্ট্যাটাসের কথা খুব মনে পড়ছে (তিন বাংলা একাডেমিতে কর্মরত ৯০ দশকের আমার প্রিয় একজন কবি। তাঁর নামটা উহ্য রাখলাম)। তিনি খুবই দুঃখ করে যা লিখেছিলেন তার সারবস্তু এইরকমঃ গত একুশের বইমেলায় তার একটি কবিতার বই বের হয়েছে। বইটি প্রকাশের অনেক আগে থেকেই ফেসবুকে অনেক আলোচনা হচ্ছিল তাঁর বন্ধুমহলে। তাঁর প্রায় পাঁচ হাজার বন্ধু ফেসবুকে। ওখানে এতো উতসাহ দেখে তিনি ভেবেছিলেন ১০% বন্ধুও যদি বই কেনে তাতেও তার অন্তত ৫০০ বই বিক্রি হবে। কবিতার বই হিসেবে যা একটি খুবই উল্লেখযোগ্য সংখ্যা। কিন্তু মেলা শেষে তিনি নিজেই এই পরিসংখ্যান উল্লেখ করে খুবই হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। পাঠক হিসেবে আমিও খুব ব্যথিত হয়েছিলাম। এতেও অবশ্য তিনি দমে না গিয়ে বইটি পিডিএফ আকারে প্রকাশ করে মাত্র ১০ টাকা করে অনলাইনে বিক্রি করার চেষ্টা করেন। তাতেও বিশেষ সাড়া মেলেনি। এই যদি হয় একজন প্রতিষ্ঠিত কবির বই বিক্রির অবস্থা তবে অখ্যাত/অপ্রতিষ্ঠিত কবিদের সম্মানী আশা করা কতোটুকু যুক্তিসঙ্গত তা সংশ্লিষ্ট লেখক-পাঠকের বিবেচনার উপর ছেড়ে দিলাম।


বিপরীত চিত্রও আছে। সেটিও খুব হতাশার। লজ্জাজনকও বটে। একটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ছে। প্রায় ২০-২২ বছর আগের কথা। বিটিভির একটা অনুষ্ঠানে গানের জন্য গীতিকারের সম্মানী নিয়ে কথা হচ্ছিলো। সেখানে সম্ভবত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন বলেছিলেনঃ সম্মানীটা সম্মানজনক হওয়া দরকার। এখানে উল্লেখ্য যে, তখনকার দিনে রেডিও থেকে একজন গীতিকার একটি গানের জন্য ১.৫০ - ৬.০০ টাকার মতো সম্মানী পেতেন। তাহলেই বুঝুন সম্মানীর কী বেহাল দশা! তারপরও রেডিও বা বেতারে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্তি একজন গীতিকারের অনেক বড় প্রাপ্তি। এতেই বোঝা যায় একজন লেখকের কাছে সম্মান যতোটা মূখ্য বিষয়, সম্মানী ততোটাই গৌণ।


শুরুতেই যেটা বলছিলাম — একজন লেখক সম্মানের জন্য লিখেন, সম্মানীর জন্য নয়। তিনি যখন সম্মান অর্জন করে ফেলেন তখন সম্মানীর জন্য চিন্তা করতে হয় না। সেটা কম-বেশি এমনিতেই এসে যায়। তাই যারা লিখতে শুরু করেছেন তাদের উচিৎ হবে লেখালেখির দিকেই মনযোগ নিবিষ্ট করা। এতে করে সম্মান অর্জন করতে পারবেন। আর সম্মান অর্জন করতে পারলে সম্মানী যে কীভাবে আসে তা যারা ইতিমধ্যেই সম্মান অর্জন করেছেন তাদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন আশা করি।


(৩০/০৮/২০১৪)