আমার একটা আকাশ আছে ছড়াকার মুস্তাফিজুর রহমান মুস্তাক এর
জ্যোতিময় আকাশের শব্দচিত্র
রহমান মুজিব


কতিপয় শিশু খেলা করছে আর কি জানি কী বলে এ ওর গায়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। এ দৃশ্য কার না ভাল লাগে! অলক্ষে দাঁড়িয়ে শুনলাম, তারা বলছে –


” আমাদের ইস্কুল দুই তিন তলা
টিফিনে খেতে দেয় রুটি আর কলা
আমাদের বড় আপা আইএ বিএ পাশ
পড়া না পারলে মারে ঠুস-ঠাস।”


অন্য একদিন নেড়ামাথার এক নিকটাত্বীয় শিশু কাঁদ-কাঁদকন্ঠে রাগে গড়গড় করতে করতে এসে বলেছে,” দাদু দাদু, মাহদিরা না- পচা! ওরা আমাকে ব্যঙ্গায় (ব্যঙ্গ করে)। ওদের সাথে আর খেলব না ।” তাকে প্রবোধ দিয়ে কান্না থামিয়ে জানতে চাইলাম,” কেন? ওরা কী বলেছে?” ও আদরে গলে গিয়ে বলতে থাকল,

“বেল্লা মাথা বেল বেল
রাখবানি গো কাঁচাতেল
কাঁচা তেলের দাম নাই
সাইকেলের পাম নাই।”


প্রিয় পাঠক, এ দুটি ক্রিয়ার যিনি অনুঘটক তিনি আর কেউ নন; তিনি ছড়া সুন্দরী। এই ছড়া সুন্দরীর অঙ্গেই বর্ণিল ভূষণ পরাতে ব্যস্ত ছড়াকার মুস্তাফিজুর রহমান মুস্তাক। সদাহাস্য এ ছড়াকার যশোর সাহিত্যাঙ্গন এবং অনলাইন মিডিয়ায় একটি পরিচিত প্রিয়মুখ। তিনি সহজাত সারল্যে হৃদয়ের কন্দর থেকে ওঠে আসা শব্দমালায় ছড়া রচনা করেন। ‘আমার একটা আকাশ আছে’ তাঁর দ্বিতীয় ছড়াগ্রন্থ। এ গ্রন্হের ছড়া নিয়ে আলোচনার প্রাক্কালে প্রাসঙ্গিকভাবেই আমরা ছড়ার ইতিবৃত্ত ও গতিপ্রকৃতির দিকে একটু পলক ফেলার প্রয়াস পাব।


একটা ভাষার সূচনা লগ্নেই সে ভাষার ছড়ার উদ্ভব । মানুষ যখন ভাষা ব্যবহার করতে শিখল, যৌক্তিকভাবে তখন থেকেই মায়ের কোলে আসা শিশু-রাজা-রানীদের তুষ্ট করতে সুরময়, ধ্বনিময়, কল্লোলময়, ঝংকারময় ছড়ার জন্ম । বাংলা ছড়াও এর ব্যতিক্রম নয়। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। সেই চর্যাপদের কবি ভুসুক পা তাঁর রচিত চর্যায় যেদিন ..


“আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী।
নিঅ ঘরিণী চন্ডালে লেলী”।


এই পদটি লিখলেন সেদিন থেকেই বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ বলা যেতে পারে। এই চর্যাপদেরই আরেক প্রসিদ্ধ কবি ’কাহ্নপা’ রচিত চর্যা–


“আলিএ কালিএ বাট রুন্ধেলা।
তা দেখি কাহ্ন বিমণা ভইলা।।…
তে তীনি তে তীনি তীনি হো ভিন্ন।
ভণই কাহ্ন ভব পরিচ্ছিন্ন।।…”


এর ধ্বনি ঝংকারের ফলে বাংলাছড়ার একটি সার্থক প্রাথমিক পর্যায় বলে মনে করা হয়  ।বাংলাসাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ইতিহাসে ছড়ার বিকাশ ও উৎকর্ষ ব্যাপক। সূচনালগ্ন লোকমুখে সৃজিত লোকজ ছড়া, প্রবাদ-প্রবচনগুলো মুখে মুখেই ভেসে বেড়াত। যুগপরম্পরায় বিভিন্ন মনিষীর মননশীল প্রয়াসে ছড়া স্মৃতির খাতা থেকে বইয়ের পাতায়, শ্রুতির গণ্ডি পেরিয়ে পঠন-পাঠন ও সাহিত্যের মর্যাদায় আসীন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে শ্রী যোগীন্দ্রনাথ সরকার লৌকিক ছড়া সংগ্রহ করে 'খুকুমণির ছড়া' নাম দিয়ে গ্রন্থভুক্ত করেন । এটিই ছড়ার প্রথম গ্রন্থিত রূপ। এ গ্রন্থটির ভূমিকায় রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী ছড়াকে সর্বপ্রথম সাহিত্যের একটি অন্যতম শাখা রূপে স্বীকৃতি দেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছড়া সংগ্রহ করে, স্বার্থক ছড়া লিখে, ছড়া নিয়ে প্রণিধানযোগ্য অভিমত রেখে ছড়া সাহিত্যকে উচ্চে তুলে ধরেছেন।তিনি ছড়ার জগৎকে মেঘের রাজ্যের সাথে তুলনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের হাতেই স্বরবৃত্ত ছন্দ 'ছড়ার ছন্দ' বলে প্রতিষ্ঠা পায়। তিনিই দেখান ছড়ার ছন্দে পর্বগুলো হয় সর্বোচ্চ চারমাত্রার ।


          ছড়া বাংলা সাহিত্যের প্রাণ; শিশুসাহিত্যের অনন্য মাধ্যম । শিশুর পড়া শুরু হওয়ার পূর্বেই ছড়া শুরু হয় । মা-খালারা ছড়ায় ছড়ায় শিশুকে নাচায়, হাসায়, ঘুম পাড়ায় । ছড়ার দোলনায় শিশুমন দোল খায় । এ কেবল শিশুদের আনন্দই দেয় না, গঠন করে মন ও মানস; বিকশিত করে কল্পনাশক্তি । বড়দের ভেতরেও একটি শিশুমন লুকিয়ে থাকে । ছড়া তাই সকলের ।বর্তমানে ছড়াসাহিত্যের ব্যাপ্তি বিশাল। সে এখন জায়গা বিস্তার করে আসন নিয়েছে সমাজ দর্পণের । ছড়া আজ কল্পনায় ভাসে, ছন্দে নাচে, রোষে ফুঁসে, চাবুকে চাবকায় । ছড়া অতীতকে ধারণ করে,  অবস্হান করে বর্তমানে এবং দৃষ্টি রাখে আগামীর আয়নায়। ছড়া একটি আন্দোলন, কালের সাক্ষী, সময়ের পাঠ । ছড়া নান্দনিকভাবে কঠিন কথা বলে ফেলে সহজে । অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
“সহজ কথা কইতে আমায় কহ যে
সহজ কথা যায় না কহা সহজে।”
এটি পারে ছড়া। পারেন ছড়াকারগণ। ছড়াতে থাকে ছবি, ধ্বনি,চিত্রকল্প।ফলে ছড়া অনুরণন তোলে পাঠকমনে ।মিলন প্রত্যাশী মানুষের মন । ছড়ার অন্ত্যমিল এবং অন্তরমিল তার মনকে ফুল্ল করে । ছড়া তাই মননশীল সাহিত্য।


ভাবতে অবাক লাগে, প্রাচীনকাল থেকেই ইংরেজী ভাষায় যেখানে ননসেন্স রাইম প্রচলিত ছিল, সেখানে ১৮৯৯ সালের পূর্বে বাংলা ছড়া, সাহিত্যের মর্যাদাই পেত না! বর্তমানেও অনেকে ছড়াসাহিত্যকে কেবল শিশুসাহিত্যে বলেই মনে করেন। ছড়াকে তারা সাহিত্যের মূলধারায় স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করতে চান। কেউ কেউ আবার বলেন ছড়াতো কবিতাই তবে ভাবটা হালকা। আধুনিক গদ্যকবিতার যুগে এসব মিলযুক্ত কবিতা বা পলকাভাবের পদ্য টিকবে? তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিনয়ের সাথে বলব, আচ্ছা চোখ-কান খুলে নির্মৌহ দৃষ্টিতে দেখে বলুন তো, সেই লোকজছড়ার কাল থেকেই ছড়া কি শুধু শিশুসাহিত্য? লোকজ ছড়ায় সমকালীন-সমাজ কি একেবারেই অনুপস্হিত ছিল? তাহলে…


“খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল
বর্গি এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে?”


এই ছড়ায় কি নবাব আলিবর্দি খাঁর আমলের মারাঠি বর্গি লুটেরাদের তাণ্ডবচিত্র উঠে আসেনি? লোকজ মেয়েলি ছড়াগুলোতেও প্রচুর সমাজচিত্র জজ্বল্যমান।


“তেলের শিশি ভাঙ্গলো বলে
খুকুর 'পরে রাগ করো
তোমরা যারা ধেড়ে খোকা
ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো
তার বেলা?”
অন্নদাশংকর রায়ের এ ছড়াতে ভারত বিভাগের যে চিত্র পাই, তাও কি ছেলে ভুলানো?


“ট্রাক!  ট্রাক! ট্রাক!
শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে
দুয়োর বেঁধে রাখ। …
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে
ফিরবে সে মিছিল” আল মাহমুদ.


“অসময়ে মেহমান
ঘরে ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার
যতগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।” (সুকুমার বড়ুয়া)


এসব ছড়া কি শিশুতোষ ঘুম পাড়ানো ছড়া?


“বিশ্ব বিদ্যালয়ে
বিশ্ব বিদ্যা লয়ে
কেউ নিশ্বঃ নয়
এই বিশ্বময়” কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার.


“পুঁজিবাদের পাঠশালাতে
এই নিয়েছি পাঠ
যার আছে তার সবই আছে
নিঃস্ব- মরুর মাঠ” প্রাবন্ধিক.


এগুলোও কি ছেলেভুলানো? কোনো গভীরতাই নাই? ভয় হয়, গভীরতা গভীরতা করতে করতে শেষে না তলিয়ে পড়ি!


একটু খুঁজে দেখুন, বাংলা ছড়াসাহিত্যে প্রচুর প্রতিকী ব্যাঞ্জনার ছড়া রয়েছে। অগ্রজ ছড়াকার আমীরুল ইসলাম গদ্য ছড়া লিখছেন। প্রবাদপ্রতিম ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন স্বরবৃত্তে মুক্তক কবে থেকেই লিখছেন। ছড়ার নানা ফর্ম গঠিত হচ্ছে, যেমন- ছড়াক্কা, লতিফা, রমুছাঁচ ইত্যাদি লিমেরিকতো আগেই ছিল। মাত্রাবৃত্ত ছন্দে আমরা অনেকেই আকসার ছড়া লিখছি। নিচের লিমেরিকটা একটু পড়ুন
“নাচে যখন আকিরা
চেয়ে থাকেন বাকিরা
        নাচের তালে
        গাছের ডালে
  গেয়ে ওঠেন পাখিরা”।প্রাবন্ধিক.


এর ছন্দ বিশ্লষণ করলে দেখবেন এখানে স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত এবং অক্ষরবৃত্ত এ তিনটি ছন্দই বিদ্যমান। ফলে  একটি ছড়াতে সাতটি ছন্দের সৃষ্টি হয়। তাহলে কেবল স্বরবৃত্তেই ছড়া লিখা হবে, তা আজকের ছড়াশিল্পীরা মানতে নারাজ । অনেক গবেষণায় তাঁরা আজ মুক্তবিহঙ্গ। বিষয় আর ইচ্ছাই নির্ধারণ করবে কোন ছড়া কোন ছন্দে রচিত হবে। বলা বাহুল্য প্রত্যেক ছড়াকারই কবি কিন্তু প্রত্যেক কবিই ছড়াকার নয়। দেখুন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই কি বলেন, ‘কবিতারই আরেকটা রূপ ছড়া। কবিতার বক্তব্য একটু ঘুরিয়ে বলা হয়, যাতে পাঠকের জন্য ভাবনার খোরাক থাকে। ছড়ার রস আস্বাদন করতে পাঠককে খুব গভীরে যেতে হয় না । এর মানে এই নয় যে, ছড়ায় চিন্তার খোরাক থাকে না। থাকে, তবে তা সহজ-স্বচ্ছ, জটিল নয়।’


সুতরাং ছড়া ছিল, ছড়া আছে, ছড়া থাকবে। প্রযুক্তি যতই আমাদের পরিবর্তন করুক, যতদিন বাংলাভাষা থাকবে, যতদিন শিশু থাকবে, যতদিন মা-খালা-বাবা-কাকা –মামারা থাকবেন, যতদিন মানুষের মনে আনন্দ-বিষাদ থাকবে, বিবেক ক্রিয়াশীল থাকবে; আরকিছু থাক বা না থাক ছড়া থাকবে। ভবিষ্যতেও যুগকে ধারণ করে আর বাঁক পরিবর্তন করে ছড়া এগোবে এ কথা যৌক্তিকভাবেই বলা যায়।


        এবার ছড়াকার মুস্তাফিজুর রহমান মুস্তাক এর ‘আমার একটি আকাশ আছে’ ছড়াগন্থ মূল্যায়ন করার প্রয়াসী হবো। গ্রন্হটি নিবিড়পাঠে দেখা যায়, সরল ছান্দিক ব্যঞ্জনা তাঁর ছড়ার প্রাণ। ছন্দবৈচিত্র্য থেকে সাবলীলতার দিকেই তিনি দৃষ্টিপাত করেছেন। দেশপ্রেম, সমাজবাস্তবতা এবং হাস্যরস তাঁর ছড়ার বৈশিষ্ট। তাঁর দেখার চোখ প্রখর। সমসাময়ীক ঘটনাকে তিনি তুলে আনেন প্রত্যয়ী-প্রযত্নে। এ বক্তব্যকে সামনে রেখে গ্রন্হ ব্যবচ্ছেদে গিয়ে দেখা যায়, এতে ছড়া আছে ৪৬ টি এবং লিমেরিক আছে ২৮টি। লিমেরিকগুলো ছড়ার বৈশিষ্ট ধারণ করে । তাই সব মিলিয়ে ৭৪টি ছড়া ধরে নেব । এর মধ্যে ৪৩ নম্বর পৃষ্ঠার ‘একা একা’ শিরোণামের ছড়াটি ও ৬৫ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম লিমেরিকটি মাত্রাবৃত্ত বা কলাবৃত্ত ছন্দে রচিত। অবশিষ্ট ৭২টি ছড়া ম্বরবৃত্ত বা দলবৃত্ত ছন্দে লিখিত । ‘হিন্দু- মুসলমান’, ‘একা একা’ ,গাড়ি চালক’, ‘এমন কিছু মাষ্টার আছে’ এ তিনটি ছড়া এবং ৫৯, ৬০, ৬৪, ৬৫, ৬৭, ৬৯ পৃষ্ঠার একটি করে মোট ছয়টি লিমেরিকে অতি সামান্য ছন্দপতন পরিলক্ষিত হয়। অবশিষ্ট ৪৩টি ছড়া চমৎকার ছন্দবদ্ধ ও ২২টি লিমেরিক- ছন্দ, শব্দচয়ন, ভাববিন্যাস ও প্রকাশভঙ্গিমায় অনন্য। মোট ৭৪ টি রচনার মধ্যে ৬৫টি যদি মানসম্পন্ন হয় তাহলে ছড়াগ্রন্থ এবং ছড়াকার  সফল, এ কথা বলা যায় নির্দ্বিধায়।


ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য তার 'লোক সাহিত্য' গ্রন্থে ছড়াকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এগুলো হচ্ছে লৌকিক ছড়া, সাহিত্যিক ছড়া ও আধুনিক ছড়া। আবার ওয়াকিল আহম্মদ তাঁর ‘বাংলা লোকসাহিত্যে: ছড়া’ গ্রন্থে ছড়াকে বার তেরটি ভাগে ভাগ করেছেন । সে সব বিচেনায় ‘আমার একটা আকাশ আছে’ গ্রন্হের ছড়াগুলোকে ১) শিশুতোষ ছড়া, ২) সাহিত্যকি ছড়া ৩) রাজনৈতিক ছড়া ৪) সমকালীন ছড়া ৫) সামাজিক ছড়া ৬) পদ্য এ ছয়টি ভাগে মোটামুটিভাবে ভাগ করা যেতে পারে।


১) শিশুতোষ ছড়া: ১৬, ২১, ২৫, ২৬, ২৮, ৩৩, ৪৪, ৪৫, ৫৬ নম্বর পৃষ্ঠার ছড়াগুলো।
২) সাহিত্যকি ছড়া: ২২, ৩৮, ৪৩, ৫১ নম্বর পৃষ্ঠার ছড়াগুলো।
৩) রাজনৈতিক ছড়া: ৪০, ৪৭, ৫৩, ৫৪ নম্বর পৃষ্ঠার ছড়াগুলো।
৪) সমকালীন ছড়া: ১৭, ১৯, ২৯, ৩৫, ৩৬, ৪৬, ৪৮, ৪৯, ৫০ নম্বর পৃষ্ঠার ছড়াগুলো।
৫) সামাজিক ছড়া: ১১, ১২, ১৫, ১৮, ২০, ২৩, ২৭, ৩১, ৩২, ৩৪, ৩৭, ৩৯, ৪১, ৪২, ৫৫, ৫৭ নম্বর পৃষ্ঠার ছড়াগুলো।
৬) পদ্য: ১২, ১৩, ৫২ নম্বর পৃষ্ঠার ছড়াগুলো।


এ ছাড়া তাঁর লিমেরিকগুলোকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সমকালীন শ্রেণিতে ভুক্ত করা যেতে পারে। এ তিন শেণীর রচনাতেই তিনি ক্ষেত্রবিশেষে হাস্যরস ও ব্যঙ্গরস স্বার্থকভাবে প্রয়োগ করেতে পেরেছেন। ছড়াগুলোতে তিনি বেশিরভাগ ক্ষত্রেই স্বরবৃত্ত ছন্দে ৮/৬ পয়ারবন্ধ প্রয়োগ করেছেন; পর্ব ৪/৪/৪/২ মাত্রা বিন্যাসে। হোক লিমেরিক কিংবা ছড়া-
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সমকালীন শ্রেণিভুক্ত রচনাগুলোতে তিনি বিবেককে জাগাতে, চেতনাকে শান দিতে তাঁর কলমকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।


এবার এ গ্রন্হের ভালোলাগা কিছু ছড়ার  নিয়ে কথা বলে আলোচনার ইতি টানব।


“শক্ত মাটি নরম করে কুমোর বানায় হাড়ি
নানান রঙের সুতা দিয়ে তাতি বুনে শাড়ি।”


চরণদুটি এ গ্রন্হের প্রথম ছড়া ‘কাজের মাঝে পরিচয়’ থেকে নেয়া। এ ছড়ার বিষয় ও শিক্ষা আকর্ষনীয়। কামার-কুমার-জেলে-তাতি ইত্যাদি নানান পেশার মানুষ যারা কাজ করে দেশকে এগিয়ে নেন তারা কর্মবীর। তাদের কাজেই তাদের পরিচয় পাওয়া যায়। তাই তারা কর্মহীন অলসদের থেকে শ্রেয়।“মানুষ বড় হয় কর্মে”। এ ছড়ায় তার সমর্থন করে কর্মী মানুষদের সম্মানীত করা হয়েছে। তাই ছড়াটি চমৎকার।  এ ছড়ারই  অন্য স্হানে “ইট বালিতে অট্রালিকা বানায় রাজের মিস্ত্রি” এখানে শব্দচয়নে দুর্বলতা লক্ষনীয়। শব্দটি ‘রাজমিস্ত্রি’ হলে নিখুঁত হতো।


“হাড়ি ধরে/ বাড়ি মারে
আমার প্রিয় গিন্নি
দিলো ঝাড়ি/ নিলো আড়ি
পড়ে গেল ফিন্নি।” (মুরদ সবই জানি)


মধুর পারিবারীক একটা চিত্র এ ছড়ায় পাওয়া যায়। গিন্নির বাড়ি ছাড়ার অম্ল- মধুর হুমকী কার ভাগ্যে না জোটে! এ ছড়াটির অনুপ্রাসে একটি চমৎকারিত্ব আছে, তা হচ্ছে- পর্বপ্রান্তিক মিল। যেমন - ধরে/ মারে, ঝাড়ি/ আড়ি ইত্যিাদি। আবার পর্ব প্রারম্ভিক মিল যথা- হাড়ি/ বাড়ি, দিলো/ নিলো ইত্যাদি। ছন্দের কারুকাজে ছড়াটি নান্দনিক।


‘হৃদয়ে যশোর’ ছড়াটি এ ছড়াকারের একটি চমৎকার কাজ। এ ছড়ায় তিনি যশোর জেলার শৌর্য-বীর্যের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। সবশেষে তিনি আর্তি জানয়েছেন-


“প্রিয় আমার যশোর জেলার
সকল মানুষ খাঁটিঁ
মরলে আমায় তোমরা দিও
এই জেলাতেই মাটি।”


মনে পড়ে গেল সৈয়দ মুজতবা আলীর সৃষ্ট চরিত্র আফগান নাগরীক আবদুর রহমানের কথা। মনে পড়ে গেল ‘ইন খাস্ত ওতানাম’।মনে পড়ে গেল দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ।


“এ কোন যুগে/ এলাম ৬
চোর বাটপার /লুটেরাদের ৮
দিতে হবে/ সেলাম….৬
ঠেলা এবার /সামলা ৬
উচিত কথা /বলতে গেলে ৮
পড়বে ঘাড়ে/ মামলা” ৬। (সময়ের ছড়া)


এ ছড়ায় ছন্দের চাল, বিষয় ও প্রকাশভঙ্গি মনকাড়া। যুগযন্ত্রণা আর সময়কে ধরার সাহসী প্রয়াস।


এ ছড়া গ্রন্হে মাকে নিয়ে দুটি ছড়া আছে। ছড়াদুটি দারুণ সার্থক।


“ছবি আঁকি গ্রাম-বাংলার পাহাড় নদী ফুল
ছকি আঁকি অট্রালিকা প্রিয়ার কালো চুল…
যত ছবি আঁকি আমি সবই গেল ঢেকে
সত্যিকারের শিল্পী হলাম মায়ের ছবি এঁকে।”( মায়ের ছবি)


“যতই বলি মা যে আমার ভোরের হিমেল হাওয়া
যতই বলি মা যে আমার স্বপ্নে খুঁজে পাওয়া…
তুচ্ছ আমার সকল বলা মা যে শুধু মা
মায়ের সাথে এই ভুবনে নেই যে তুলনা।” ( মা যে শুধু মা)।


এভাবে আরও প্রচুর উদ্ধৃতি দেয়া যাবে। চরকি বুড়ি, মানুষ, জীবন হবে খাঁটিঁ, বিড়ি টেনে কুপোকাত, হিন্দু-মুসলমান, সবিতার কবিতা, বাবা ঘরের খুঁটিঁ, আমার একটা আকাশ আছে, মডেল টাউন, নেতার গাড়ি, সবখানে চাই বাংলা ভাষা, হায়রে গণতন্ত্র, মোবাইল ফোনে চ্যাট, ইলেকশনে, আমার পাড়ার দুষ্টু ছেলে শিরোনামের ছড়াগুলোও চমৎকার ছন্দবদ্ধ ও আনন্দদায়ক।


মুস্তাফিজুর রহমান মুস্তাক এর শিশুতোষ ছড়াগুলো সব বয়সের পাঠককেই আনন্দ দেবে। শিশুসাহিত্যের স্বরূপ খুঁজতে গিয়ে আশা গঙ্গোপাধ্যায় ‘বাংলার ব্রতকথা’য় যথার্থই বলেছেন : ‘যথার্থ শিশুসাহিত্য বলিতে তাহাই বুঝিব, যাহা সর্ববয়সের নরনারীর কাছেই একটি রসাস্বাদ আনিয়া দেয়, বয়সের পার্থক্য অনুসারে আস্বাদনের ব্যাপারে কিছু বিভিন্নতা ঘটিতে পারে কিন্তু সর্বস্তরের মানুষকে আনন্দদান করিবার মতো শিল্পগুণ তাহাতে থাকিবে।’ মুস্তাফিজুর রহমান মুস্তাক এর ছড়ায় এটি আছে।


লিমেরিক:-
আঠার শতকের গোড়ার দিকে  ইংল্যান্ডের ইংরেজি সাহিত্যে লিমেরিকের প্রচলন। উনিশশতকে এডওয়ার্ড লিয়র রচিত  (A Book of Nonsense, 1846) গ্রন্হের মাধ্যমে বাড়তে থাকে এর জনপ্রিয়তা। যদিও তিনি এগুলোকে “লিমেরিক” নামে নামকরণ করেননি। লিমেরিক আয়ারল্যান্ড এর একটি স্থানের নাম। এই স্হানের নাম অনুসারে এর নামকরণ হয়।  লিমেরিক “ Limerick” হাস্যরসাত্মক ছড়াধর্মি ছোট কবিতার এক কালজয়ী রচনাশৈলী । এ ফর্মটি ৫ টি চরণে গঠিত। এর অন্ত্যমিলবিন্যাস  ‘ ক ক খ খ ক’।  ১ম, ২য় ও ৫ম পঙ্‌ক্তির চেয়ে ৩য় ও ৪র্থ পঙ্‌ক্তি মাপে ছোট হয়ে থাকে। ইংরেজি নার্সারী রাইম (Nursery rhyme) এর ধারায় লিমেরিকের বক্তব্যে অর্থবোধকতার চেয়ে দ্যোতনাই বেশী প্রাধান্য পায়। সময়ের বহমানতায় লিমেরিক তার আওতা বিস্তৃত করে। লিমেরিক এখন হাস্যরসের পাশাপাশি সমাজবাস্তবতা এবং রাজনীতিনির্ভর বিষয়াবলী তির্যকভাবে প্রকাশ করার অনন্য মাধ্যম হিসেবেও সমান দক্ষ। ছড়াকার মুস্তাফিজুর রহমান মুস্তাক এর ‘আমার একটি আকাশ আছে’ ছড়াগন্থের লিমেরিকগুলো এ ধারারই সাক্ষ্য বহন করে। লিমেরিকে তিনি সাম্প্রতিক হলেও তাঁর  লিমেরিক পাঠ মানে আনন্দের সাথে ভ্রমণ। যেমন-


“কলকাতার এক ক্যান্টিনেতে মিষ্টি বানায় ময়রা
ডাকলে কাছে আসে না সে কারণ সে তো বয়রা
কুচকুচে তার কালো গা
লুঙ্গি পরে খালি পা
বাড়ি তাহার খুলনা জেলার কয়রা।”


এ লিমেরিকের হাস্যরস আমাদের আমোদিত করে। আবার দেখুন

“আতঙ্ক আজ ঘরে ঘরে নেই তো চোখে ঘুম
তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে বন্ধ করি রুম…
দেশটা জুড়ে চলছে যেন লাশের মহাধুম”

“কেতর আলী পথে পথে বেচে বেড়ায় ছোলা
দুইশো সিসি হোন্ডা চালায় তারই বড় পোলা….
দরকার আছে ওই সকলের রহস্যটা খোলা।”


এ লিমেরিকগুলোতে সমাজের হালচাল নিপুণ ভাবেই তিনি তুলে ধরতে পরেছেন; অথচ কন্ঠ ততটা চড়া করতে হয়নি। এ ধরণের আরও দৃষ্টান্ত তাঁর লিমেরিক থেকে দেয়া যাবে। রসগ্রাহী পাঠক নিশ্চয় খুঁজে নেবেন। মুস্তাফিজুর রহমান মুস্তাক এর সাহিত্যজীবন আলোচনা করলে দেখা যাবে তাঁর প্রথম ছড়ার বই ‘কোথায় যাব’ থেকে আলোচ্য গন্হের রচনাগুলোর উত্তরণ প্রচুর। এতে প্রমাণিত হয় তিনি সঠিক পথেই হাঁটছেন। তার উত্তরণ রেখা উর্দ্ধগামী। ক্রমাগত চর্চা, ছন্দে বৈচিত্র্য ও শুদ্ধতা, বাগ-বিন্যাসে সতর্কতা তাঁকে বাংলা ছড়াসাহিত্যে অনিবার্য করে তুলবে।

গ্রন্হের নামআমার একটা আকাশ আছে । নামকরণে একটা আকাশের খবর আমরা পাই। এ আকাশটি ছড়াকার মুস্তাফিজুর রহমান মুস্তাক এর একান্ত আকাশ। মনের আকাশ। এখানে রোদ হয়, মেঘ হয়, কালোমেঘের ঘনঘটা নামে, বিদুৎ চমকায়, রংধনু নাচে, তারা ঝলমল করে, উল্কাপাত হয়।তাঁর মনের আকাশে যেসব হয়, সেসব অভিজ্ঞতাই তিনি ছড়ার ছন্দে লিখে গ্রন্হভুক্ত করে উপস্হাপন করেছেন। এ গ্রন্থপাঠ মানে তাঁকেই পাঠ। তাঁর আকাশরূপী মনের কথাই এ গ্রন্হ। সুতরাং আমার একটা আকাশ আছে   ছড়া গ্রন্হের নামকরণ সার্থক।


নাগরী, বারুতখানা, সিলেট থেকে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত সাড়ে চার ফর্মা বা ৭২ প্রষ্ঠার এ ছড়াগ্রন্হের দৃষ্টিনন্দন বহুরঙের প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী সমর বিপ্লব। প্রচ্ছদ গ্রন্হেরমূল থিমের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। অফসেট প্রিন্ট, বোর্ড বাঁধাই এবং উন্নতমানের কাগজে ছাপা এ বই এর গ্রন্হপরিকল্পনা নান্দনিক। বইখানার অনলাইন পরিবেশক: রকমার ডট কম এবং সরাসরি পাওয় যাবে: বইহাট, সার্কিট হাউজ পাড়া, যশোর এ। আমরা গ্রন্হটির বহুলপ্রচার কামনা করি।
-০-