'কড়ির হসেব’ মন কাদামাটির মত কোমল করে দেয়


"যাবার সময় হলে,/ সবে পাবে বেদীমূলে
যদিও নিজে তখন দূরে।
ছল নেই কাজে তার,/ কাণ্ডারী করে পার,
বাশরী বাজায়ে সুরে সুরে”।
সমিত্র দত্ত রায় এর 'কড়ির হসেব’ অনুকাব্যটি পড়তে পড়তে প্রথমেই রবি বাবুর কালজয়ী পঙতি “মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান”মাথায় এসে ভিড় করে। একটি মরমীগান “রিটান টিকেট হাতে লইয়া আইসাছি এ দুনিয়ায়/ টাইম হইলে যাইতে হইবে/ যাওয়া ছাড়া নাই উপায়”  এবং বাংলা ছায়াছবির একটি গান “ আছেন আমার মুক্তার… পারাপারের থাকলে তাড়া/ সঙ্গে নিও গাড়ি ভাড়া..” স্মৃতিতে বাজতে থাকে। আসে  লালন ফকির এর “খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়…”। জলের আয়নায় অকাশও নিজের মুখ দেখে। তাই আলোচকের দুটি চরণ “মরণকে আর ভয় কি বলো , মরণতো স্রেফ খেয়া/ মনের সুখে এপার থেকে ওপার পাড়ি দেয়া” সামনে আসে। ভাববাদের চারণভূমি এ উপমহাদেশ। শুধু মরণ নিয়ে বাংলায় রচিত কবিতা, গান,মরমী সাহিত্য গবেষণায় বিরাট গ্রন্থ রচিত হতে পারে। সুতরাং মূল প্রতিপাদ্যে ফিরে আসা যাক।  স্বল্পবাক কবিতাটির মূলসুর – আয়ূ ফুরিয়ে গেলে মানুষকে লাশ হয়ে যেতে হয়। সৎকার বা কবরস্থ করার জন্য শুধু অবয়বটা থাকে। মূল, যাকে আমরা আত্মা বলি– সে তখন দূরে চলে যায়। অথাৎ শূন্য খাঁচা পড়ে থাকে, পাখি উড়ে যায়। আর যে কাণ্ডারি পার করে নিয়ে যায় তাঁর কাজে কোন ছল নাই। অমোঘ নিয়মে যথা সময়ে যথাযত ভাবেই এটি ঘটে।
এখন কথা হলো এ ভাব তো অতি পুরানো। তো এ কবিতা আমরা কেন পাঠ করব? এর মধ্যে বিশিষ্টতা কী আছে? আসুন দেখতে সচেষ্ট হই ।  উপরে উদ্ধৃত অন্যান্য গান কবিতাগুলোতে ভাববাদ বা তার ছায়া আছে। আলোচ্য কবির কবিতার নামটি ছাড়া কাব্য অন্তরে বাস্তবতার প্রতিফলনই বর্তমান। কবি বলেতে চেয়েছেন দুনিয়ায় এলাম, মেয়াদ শেষে যেতে হবে। একেবারে বাস্তব। অতপর কি হবে সে ব্যাপারে কবি নিরব থেকে বিষয়টি আড়ালে রেখেছেন। এটি এ কবিতার বিশেষ দিক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। একটি দেহ বেদীমূলে আছে, এ দেহে যে ছিল সে এখন নাই। সুতরাং সে দূরে। এটিও বাস্তব।
একটি চরম প্রশ্ন মরণ! প্রথম মৃত্যর পর থেকেই হয়তো সে প্রশ্নের উদ্ভব। তা নিয়ে যদি মাত্র ছয়টি চরণ আমাদের ভাবাতে পারে তো কবিতাটি পাঠ জরুরি ভাবা যেতেই পারে। বাড়তি হিসেবে পেতে পারি চিত্রকল্প। কাণ্ডারি এসে বংশিধ্বনি শুনিয়ে শুনিয়ে নিয়ে যাবে। মরণভীতি জয়ের টনিক। কড়ির চিন্তাটা নিজ নিজ থেকে যাক। কোনো বিভেদ থাকল না, ক্ষতি কি?
ছান্দসিক কবির ছয় চরণে রচিত অনুকাব্যটি মাত্রাবৃত্ত বা কলাবৃত্ত ছন্দে ৪২ মাত্রায় সমাপ্ত হয়েছে। মূল পর্ব ৮ উপপর্ব ২, মিল বিন্যাস ককখ/গগখ। কাণ্ডারী, বাঁশরী বানান সিদ্ধ হলেও কাণ্ডারি, বাঁশরি প্রাধীকার পেতে পারে। হলে এবং মূলে অন্ত্যমিল একটি অ কারান্ত্য অন্যটি উ কারান্ত্য। একই হলে আরো ভাল হয়।
অল্প কথায় জীবনের শেষ অঙ্কের গল্প বলে কিছুক্ষণ মনটা কাদামাটির মত কোমল করতে পারায় চতুর কবিকে শুভেচ্ছা।