এসময়ের কবিতার একটি ধারা চিহ্নের আড়ালে চিহ্ন, দৃশ্যের অন্তরালে দৃশ্য দেখায় প্রতিশ্রুত । যা কিনা শব্দের মধ্যে থেকে শব্দাতীত বোধের শিখা প্রজ্জ্বলন প্রয়াসী । যেন ঘরের বাইরে বেরিয়ে ঘরকে দেখা । এ দেখা বিচ্ছিন্নভাবে দেখা নয় । এ এক বিশেষ নির্মাণ । এটি প্রতীকবাদ (Symbolism) । বোদলেয়ার, মালার্মে-ভ্যালেরি, র্যাঁ বো এধারার মহাজন। প্রতীকবাদ ফরাসী তথা প্রাশ্চাত্যের ফসল হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। বাংলার মরমী সাহিত্য তথা বাউল ঘরানার গানে প্রতীকীব্যঞ্জনা এরও আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল । লালন, হাসনের গানে প্রতীকের উপস্থিতি প্রতুল । একটি প্রবাদের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক । ‘ঝিকে মেরে বউকে শেখানো’। লোকজ উপকরণ একটা জনপদের লোকমানসের প্রতিবিম্ব। এ প্রবাদে বাঙালির প্রতীক প্রীতির স্বাক্ষর মেলে । বাংলাভাষার ত্রিশের কবিরা পাশ্চাত্য ধারায় কাব্য লিখে যশস্বী হয়েছেন। জসিম মাহমুদের “নশ্বরতার খোলস” কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতায় এ ধারার স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় । কিন্তু তিনি পাশ্চাত্য ধারায় নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেননি। বরং দুটি ধারার সমন্বয় ঘটিয়ে প্রবণতা রেখেছেন মাটিগন্ধি । এটি কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ । গ্রন্থটি পাঠে কবির কাব্যমানস এবং ছান্দসীকতা আমাদের আশান্বিত করে । একজন পাঠক হিসেবে গ্রন্থস্থিত কবিতা থেকে কিছু উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে আমরা উপরের বক্তব্যকে বুঝে নিতে চাইব ।


“বাঘিনীর দুধ পান করে আকাশ ছুঁয়েছি….
আজ সৃষ্টিতত্ত্বে মজে যাব–
অন্দর মহলে লাল-নীল ডানা দুলে যায়।….
পরদার ধুলো ঝেড়ে চোখ তুলে চেয়ে দেখি
আকাশ অনেক দূরে”।         (বাঘিনীর দুধ )


বাঘিনীর দুধ কি কবি পান করেছেন? যদি করেও থাকেন তা কি বনের বাঘিনী? নাকি অন্য কিছু? অন্দর মহলে লাল-নীল ডানা কোথায়? এ ডানা কোন ডানা? কবিতার দীক্ষিত পাঠককে তা খুজেঁ নিতে হয় । সুতরাং উপরের বক্তব্য এখানে ভালোভাবেই দৃশ্যমান । ‘বাঘিনীর দুধ’ এখানে সাহসের প্রতীক এবং ‘পরদার’ ধুলো দৃষ্টির প্রসারতা বা আত্মবোধন (self realization) হিসেবে এসেছে । স্বপ্ন রঙিন, বাস্তব বন্ধুর । এ সরল সত্যকে শারীরবৃত্তীয় আবহে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করেছেন কবি ।


“অ্যানাকোন্ডা…
পেঁচিয়ে রেখেছে আমায়…
ছাড়াতে পারি না।…
ওর মেরুদণ্ড কবজা করার অপ্রতুল প্রয়াস–চলতে থাকে…
এ দ্বন্দ্বে আমিই হবো জয়ী”।


(অ্যানাকোন্ডা)


এখানে অ্যানাকোন্ডা অশুভশক্তির প্রতিমূর্তি । মেরুদণ্ড এসেছে দাপট হিসেবে । সৃষ্টি হয়েছে একটা সংঘাতের । এ সংঘাত সুর আর অসুরের । কিংবা আমি ও আত্মরিপুর । পরিশেষে জয়ী হওয়ার সাহসী আশাবাদ ।


“ফলে পরিপূর্ণ গাছটি ।
…মালিকের চক্ষু স্থির…
ফলটি আনবে পেড়ে ।
… সে ফলের দিকে চেয়ে চোখ ছানাবড়া!
পাখিটা পরম সুখে তা করছে আস্বাদ”।


(সময়ের তির)


  এখানে ফল, মালিক, পাখি তিনটিই প্রতীক। কবিতাটিতে “সময় গেলে সাধন হবেনা” লালন বোধন এবং হরিশচন্দ্র মিত্রের “খেলায় মজিয়া শিশু …/তাই বলি বৃথা কাল করিও না ক্ষয়/ আপনার কাজ করো থাকিতে সময়”শিশুতোষ ছড়ার বিনির্মাণ দেখলাম। এখানে ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’ প্রবাদের অনুরণন শোনা যায়।


“নতুনের নেশায়
কাকের পালক ছেঁটে
ময়ূরের পুচ্ছ লাগিয়ে দিয়েছি ।
….পেখমটা খাটো করে
মিশে যাও শকুনির দলে” ।


(ছদ্মবেশ)


কবিতাটিতেইমিটেশান হাসি (পলিমাটি ডট কম) শিরোনামের “ কাক ধরেছে ময়ূর ফ্যাশন/ মুখের হাসি ইমিটেশন/ মনের সুখে করলে কাকা/ বুঝেন লোকে সবই ফাঁকা/ যায় কি ঢাকা লিমিটেশন?” ছড়ার আওয়াজ পাওয়া যায় । কিন্তু প্রকাশভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কবিতার সৌন্দর্য তার প্রকাশভঙ্গিতে । জসিম মাহমুদের প্রকাশভঙ্গি, কাব্যভাষা নিজস্বতার দিকে যাত্রার অভিপ্সা তাঁকে প্রতিশ্রুতিশীল কবিদের কাতারে এনে দেয় । রসিকতা বোঝে না হেমন্ত, নিষিদ্ধ অভিসার, আঙিনায় বটগাছ চাই না, মহিরুহ-বীজ  ইত্যাদি কবিতাও কবির প্রতিকী ব্যাঞ্জনার কাব্যকথা বলে বিবেচিত হবে ।

বিবৃতিধর্মী কবিতায়ও কবির চলন ঊর্মিময় ।


“জন্মটাই চরম রহস্য
আরও রহস্য দ্বিতীয় জন্ম;
…..তবে দ্বিধা কী
আনন্দিত হও কর্মে
সবস্হান থেকে তোমার জন্য তো আশীর্বাদ
পুষ্পবৃষ্টির মতো ঝরবেই”।


(দ্বিতীয় জন্ম)  


এখানে, ‘মানুষ বাঁচে তাঁর কর্মে’ এ আপ্তবাক্যের মৃন্ময়ী উপস্থাপন পাওয়া যায় । লালদিঘির সিঁড়ি, শহিদমিনার, পালের হাওয়া, অকৃত্রিম ভালোবাসা , নৈপুণ্য নিদর্শন  এ কবিতাগুলো তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবে । কবির কাব্যভাষা সরল কিন্তু তরল নয় ।
ছন্দহীন কবিতা, কবিতার ফসিল মাত্র । কিন্তু এ কবি ছন্দের ছাত্র । তার কবিতা ব্যবচ্ছেদে দেখা যায়


“ …আমরা সবাই/ মুক্তিকামী/ মুক্তি পাব/ কিসে?
মুক্তিদাতা / আঙুল চোষে/ গান গেয়ে যায় শিষে”।


(মুক্তি পাব কিসে)  


ছড়া-কবিতাটি স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত । মুক্তক। মাত্রা গণনায় ঠিকঠাক । কিন্তু কানের বিচারে দুটি স্থানে কাজ করার সুযোগ আছে । যেমন– মহামুক্তির শব্দটি চার মাত্রার । কিন্তু শেষে দুটি রুদ্ধ সিলেবল থাকায় কান নিতে চায় না । আবার যেই মূর্খের শব্দদুটি বিকল্পে  চার মাত্রার। এখানে তিনটি রুদ্ধ সিলেবল রয়েছে । মাত্রা নির্দেশিত হয় ধ্বনি উচ্চারণের সময় পরিমাপে । তাই হয়তো চার মাত্রা হিসেব করা হয় । তবে  শব্দজটের ফলে স্বরবৃত্তে কানের সায় মেলে না ।  এটি এড়য়ে চলা ভাল।


“অমানিশা রাত যদি/ গিলে খায় চাঁদ//
চাতকের চোখ তবু /দ্যুতি চমকালো//
আকাশের মুখে দেখে /বৃষ্টির আলো”।         (চাতক)  


৮,৬/ ৮,৬/ ৮,৬ মাত্রাবৃত্তের স্বাচ্ছন্দ প্রয়োগ । কিন্তু জোড়াহাঁস  কবিতায়  “জানালার পরদা / ভাঁজ খুলে নামে” এখানে এক মাত্রার ঘাটতি পীড়া দেয় ।


“যে খোলস পরে এসেছি
যাবার সময় এখানেই ত্যাগ করে যাব
কর্ম-বুদ্ধিবৃত্তি-অনুভূতি নিয়ে
রহস্যের ডানা মেলে অনন্ত ওপারে”।           (নশ্বরতার খোলস )


গদ্যের গরিমা দেখা গেল । জসীম মাহমুদের কবিতার অভিযাত্রা প্রদক্ষিণে দেখা যায় তিনি আধুনিক মতবাদে প্রণীত হয়েও মৌলিক বাংলা ছন্দের অনুরাগী । এক নদীতে পাশাপাশি চলে দুধারার জল । এটিও আমাদের আশাবাদী করে ।



A critic is to set up a judge of values. I judge noting I only say what I feel. এ বক্তব্যের সাথে সহমত পোষণ করে জসিম মাহমুদের কবিতার আর একটি দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক:


১) “জোড়াহাঁস চিরকাল ব্যবধান হীন”। (জোড়াহাঁস)
২) “শকুনিদের  জীবাশ্ম থেকে চরিত্র পেয়েছে কিছু মানুষ”। (শকুনিদের  জীবাশ্ম)
৩) “একাকী জীবন একাকী লতার মতো অসহায়”। (একটি লতার গল্প)
৪) “সময় বুলেটের চেয়ে মুল্যবান”। (ফাঁদ)


এ ধরনের কিছু সদুক্তি তাঁর কবিতায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে উপ্ত হয়েছে, যা সত্যসন্ধিৎসার দিকে কবির যাত্রাকে নির্দেশ করে । একজন কবির কোনো কবিতার দুএকটা লাইন তুলে এনে কাব্য বিচার করা অনেকটা কোনো বাগান থেকে দুএকটা ফুল তুলে এনে বাগানের সৌন্দর্যকে দেখানোর নামান্তর । পূর্ণাঙ্গ সৌন্দর্য দেখতে হলে বাগানেই যেতে হয় । আবার কবিতার মর্ম উদঘাটন করার বিপদও অনেকখানি । দেখা গেল আমরা যা এখানে ভাবলাম কবি হয়তো সেভাবে ভাবেননি । এতে কিছু যায় আসে না । Multi Text কবিতার ঐশ্বর্য্য। পাঠক তাঁর চিন্তা-চেতনা-শিক্ষা-রুচির ভিত্তিতে কবিতাটি বুঝে নিতে চাইবে । এভাবেই কবির মৃত্যু এবং পাঠকের জন্ম ঘটে।আজকের দিনে পাঠক শুধু পাঠকই নন, একজন বিশ্লেষণকারীও বটে। কবি আল মাহমুদ রহস্যময়ী কবিতাকে মক্তবের মেয়ে চুল খোলা আয়েসা আক্তারের সাথে তুলনা করেছেন । একজন দীক্ষিত পাঠক আয়েসা আক্তারের মন পেতে সানন্দে পাথর কাটে ।


এগ্রন্থের প্রথম কবিতায় কবি সৃষ্টিতত্ত্বে মজে যেতে চান । আবার শেষ কবিতাতেও সৃষ্টিতত্ত্বের কথাই বলেছেন । এতে কবির পরিপক্ক পরিকল্পনার স্বাক্ষর পাওয়া যায় । নশ্বরতার খোলস গ্রন্থের শেষ কবিতা । এখানে কবি আল কুরআনের অমোঘ বাণী ‘কুল্লু নাফসিন যা–ইক্বাতুল মাওতি’। এবং প্রচলিত লোককথন ‘দুনিয়া আখেরাতের শষ্যক্ষেত্র’ এর মর্ম থেকে রত্ন কুড়িয়ে মালা গেঁথে কবিতাকন্ঠে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন । তিনি সব ফেলে রেখে নিয়ে যেতে চান কেবল ‘কর্ম-বুদ্ধিবৃত্তি-অনুভূতি’ । কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ছাড়পত্র কবিতায় নতুন শিশুকে স্থান ছেড়ে দিয়ে যাবার আগে পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে যেতে চেয়েছেন । দুজনের চাওয়া আপাতদৃষ্টে দুটি হলেও মূলে কাছাকাছি। দুজনেই পৃথিবীতে কাজ করতে চান । পার্থক্য দুজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিদ্যমান । অগ্রজ কবি বিপ্লবী, তিনি কেবল দিয়ে যেতে চান । অনুজ কবি মরমী তিনি এপারের অর্জন ওপারে কাজে লাগাতে চান । একজন কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থে যদি এতো সুরভির সন্ধান মেলে তাকে নিয়ে প্রত্যাশার পারদ চড়তির দিকে নেয়া যেতেই পারে । প্রয়োজন কবির আত্ম-উপলব্ধি ও পাথর কাটা পণ এবং নিজেকে নার্সিং করা ।


উদীয়মান প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান নাগরী, বারুতখানা, সিলেট থেকে আমর একুশে বইমেলা ২০১৬ উপলক্ষে গ্রন্থটি প্রকাশিত, মূল্য ১৪০ টাকা । এর দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী তৌহিন হসান । অনলাইন পরিবেশক রকমারী. কম ।