দেখতে দেখতে একটা বছর পেরিয়ে গেল। আজ নবীনের বাবা ও মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। সাদা ধুতির খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে দূরে বারান্দার এক কোণে রাখা বাঁধানো বন্দি দুটি ফ্রেমের দিকে চোখ পড়ল নবীনের। রজনীগন্ধার মালা গলায় সুগন্ধি ধূপের ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে আসছে নবীনের চোখ বারংবার। আর মনে পড়ছে ঘটে যাওয়া কত সুখ-দুঃখ বেদনায় ভরা ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি কথা।
বাবা, মা,ভাই এক বোন নিয়ে গ্রামের  কুঁড়ে ঘরে থাকতো তারা।  টানা পোড়েনের মধ্যেও  আনন্দে ভরে থাকতো তাদের দারিদ্রতার সুখের সংসার।তিন জনের খাওয়ার পাঁচ জন মিলে  মিশে খেত । এমনই সময় এই দরিদ্রের সংসারে একটি সুখবর এলো। তারা দূর সম্পর্কের আত্মীয়র সূত্রে কলিকাতার টাউনের উপর একটা চায়ের দোকান খোলার অনুমতি পেলা। বাবা মা রওনা হলেন তাদের স্বপ্ন পূরণের পথে। ভাই অষ্টম শ্রেণী,বোন সপ্তম , নবীন সবে মাত্র মাধ্যমিক দিয়েছে , ভাই বোনদের পড়াশুনো থেকে সংসার ,ওদের স্বাদ আহ্লাদ, নবীনকে দেখতে হত । সিঁড়ির তলায় ছিল তাদের চায়ের দোকান ,রাত দিন এক করে তাদের পড়াশুনো,তিন বেলা খাওয়া দাওয়া,পোশাক পরিচ্ছদ কোনোটাই অভাব রাখেনি নবীনের বাবা ও মা।
ধীরে ধীরে ঘর বাড়ি,জমি জায়গা সব হলো। জীবনের মোড় ঘুরে গেলো । B.A অনার্স শেষ করে নবীনও বাবা ও মায়ের কাজের সহযোগিতা করতে লাগলো । এমনি করে কেটে গেল পাঁচটি বছর , তাদের সংসারে আজ আর কোন অভাব নেই,নেই খাবারের অভাব ,নেই  পোশাকের, মা ও বাবার মুখে ফুটে উঠতো একটা পরিতৃপ্তির হাসি। এমনি ভাবে সুখের সংসার হাসি খুশিতে কেটে গেল বেশ কিছু দিন। দেখতে দেখতে এলো দূর্গা পুজো  নতুন জামা কাপড় পরে মা বাবা ভাই-বোনেদের নিয়ে আনন্দে কেটে গেল নবীনের কয়েকটা দিন। তারপর এলো কালীপুজো। কালী পুজোয় সেজেছে কলিকাতা জন মানুষের ভিড়, নবীনের মনে খুব আনন্দ , ভাই বোনেদের নিয়ে পুজো দেখব সঙ্গে দোকানের কাজে হাত লাগাবে।
প্রচুর ভিড় নবীনরা সবাই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ,মা চা তৈরি করছে ,বাবা ট্রে তে সাজিয়ে দিচ্ছে আর নবীন ও তার ভাই বোন হাতে হাতে কাস্টমারদের পরিবেশন করছে ।  রাত্রি তখন পৌনে ১১ টা দোকানের সামনে  নবীন বসে ,ভাই ও বোন ওরা ঠাকুর দেখতে গেছে ,ওরা তো ছোট তাই নবীন বললো তোরা ঘুরে আয়।  হটাৎ মায়ের চিৎকার ,আধ সেকেন্ড ও যায়নি বাবাও চিৎকার আগুন,,,,,, আগুন,,,,,বাবু ,,,,, বাবুরে বাঁচা.....
পেছন ঘুরে নবীন দেখে দাউ দাউ করে জ্বলছে মা। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের ফুলকি ।সামনে এখনো যাচ্ছে না । মা অসহ্য আগুনের দহনে রাস্তায় আছড়ে পড়ল,বাবা দরজার হোচট খেয়ে মুখ থুবড়ে । হাজারো মানুষের কোলাহল চিৎকার ,কিন্তু সবাই নির্বাক চোখে চেয়ে ...!ছেড়া বস্তা ,ছেঁড়া কাঁথা,কম্বল চাপা দিয়ে আগুন নিভালো ,মালিক কাকু দৌড়ে এসে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে বাবা ও মা কে নিয়ে চলল হসপিটালে । অসহ্য যন্ত্রনায় মা বলে বাবু তোর বাবার কিছু হয়নি তো ,অপর দিকে বাবা বলছে তোর মা কেমন আছে? উত্তরে এই বোবা মুখে কিছুই আসেনি নবীনের।
Icu তে ভর্তি করা হলো ,রাত্রি তখন তিনটে ।
ভাই বোনের কান্না ,,,দাদা মা বাবা ঠিক আছে তো? অসহায় নবীন তো বড় দুঃখ কে চাপা দিয়ে বললো তেমন কিছু হয়নি ,ভেঙে পড়িস না।বুকের তীব্র যন্ত্রনা ,চোখের সামনে মা ও বাবার বাঁচবার চিৎকার ,নিদারুণ ঘটনার সাক্ষী নবীন নিজেই।


ভোর পাঁচটায় তখন নার্স ওদের দিকে এগিয়ে আসছে নবীন একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল ...  মা কেমন আছে? নার্স মুখ নিচু করে বললো পারলাম না,মা আর তোমাদের মধ্যে নেই। ভাই বোনে ঘুমিয়ে আছে হসপিটালের মেঝেতে । ঘুম ভাঙ্গলে বলবে  মা কেমন আছে? কি উত্তর দেব ? শব্দ বিহীন কণ্ঠ ,নিদ্রাহীন চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে বুকের উপর। দৌড়ে দিল বাবার কাছে ,বাবা বন্ধ চোখে জিজ্ঞাসা করল বাবু তোর মা কেমন আছে? একটু দেখতে ইচ্ছে করছে। নিয়ে চল বাবু একটু দেখি ।
  কি উত্তর দেবে জানা ছিল না। জানা ছিল না এই রকম প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। বাবাকে কি করে বলবে মা আর নেই সব মায়া কাটিয়ে অজানা দেশে চলে গেছে । বাবার অবস্থা একেবারে ভালো নয় । নিজেকে সামলে বলল বাবা মা,,,,মা তো
খুব,,,,, খুব ভালো আছে । জানো বাবা  মা বলছিল  তোর বাবা কেমন আছে । বলিস আমি ভালো আছি।
মায়ের নিথর দেহ নিয়ে রওনা হলো গ্রামের বাড়ির দিকে ।
মায়ের শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে ফিরলো পরের দিন বিকেল ৪ টায় । ভাই বোনের কান্না থামাতে পারিনি , মোছাতে পারিনি চোখের জল, মা হারানোর কষ্ট ভোলানোর ঔষধ কিনে দিতে পারেনি সেদিন নবীন ।


বাবার পরিস্থিতি খুব একটা ভালো নয় । বাবার বেডের কাছে ধীর পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল নবীন বাবার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করল বাবা তুমি কেমন আছো? উত্তর আসেনি ।আবার জিজ্ঞাসা করলো বাবা .... ও বাবা ... চিৎকার করে ডাকলো বাবা ও বাবা .....!!!!!!
বাবার সাড়া পায়নি ,নার্স কে ডাকলো , বললো আমার বাবা কথা বলছে না কেন বলো বলো । ডক্টর বাবু  নিশ্চুপ হয়ে মাথা নাড়িয়ে নবীনের কাঁধে হাত রেখে বলল দুঃখিত পারলাম না।
আকুল আবেদন ওই দিন ভগবান শুনতে পায়নি । এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে ঈশ্বর। সুখের মুখ দেখে গেল কিন্তু সুখ ভোগ সবার কপালে আসে না । অনাথ করে দিয়ে চলে গেল তাদের । আজও নবীন তাকিয়ে থাকে আকাশের সেই জোড়া তারার দিকে। মনের অজান্তে সেই তারাদের জিজ্ঞাসা করে বাবা মা তোমরা কেমন আছো? কোন উত্তর মেলেনা শুধু কানে ভেসে আসে সেই নিদারুণ চিৎকার ধ্বনি আগুন,,,,,,, আগুন,,,,,বাবু,,,,বাবুরে,,,,,বাঁচা,,,,,,