সবে মাত্র কলেজের অধ্যাপক হয়ে এসেছেন
অল্প বয়েসী নির্মল চৌধুরী
মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি
দেখেই মনে হয় উঠতি বয়েসের যৌবন ছাপ
পাকা লিচু অধর
নাকটা একেবারে গিরিখাতের ভঙ্গিতে খাড়া
দু’চোখের তারায় কেঁপে ওঠে চন্দ্রনাথ পাহাড়
হাসি মাখা ঠোঁটটা বন্ধ থাকলেও মনে হতো
অনেক অনেক চিত্র কথার ভিড়
মুখ দেখে মনে হতো
যেনো অ-নে-ক কালের চেনা


ক্লাসে যখন বাংলা পড়াতেন
ব্যালল তাকিয়ে থাকতাম
আমি তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র
নদীর স্রোত  উপছে পড়া স্বপ্ন চোখে
হৈমন্তী গল্প শুনে নিজেকে কতবার অপূর্বর স্ত্রী মনে করেছি
আর নির্মল চৌধুরী আপনাকে মনে হয়েছে
গভীর প্রেম পূজারী অপূর্ব
বিলাসী গল্পে উত্তাল প্রেম তরঙ্গে ভাসতাম
আপনাকে নিয়ে সেই পাহাড়-বন-জঙ্গল পেরিয়ে
মৃত্যুঞ্জয় ভেবে মনে মনে ওঝা খুঁজতে যেতাম
তৃষ্ণায় বিদূর তাকিয়ে থাকতাম থ  হয়ে


কখনো খুব একটা রাগ হতেন না
মনে আছে একবার-
দুষ্ট এক ছাত্রের প্রশ্নে খুব ক্ষেপেছেন
তখন দেখলাম সরু নাকটা
শ্রী মহাশয়ের কেমন ফুলে ওঠেছে
যেন ফেটে যাওয়া পাকা ডালিম
আপনার মায়াবী মুখটা যতই দেখতাম
ততই আপনার প্রতি ভীষণ দুর্বল হয়ে যেতাম
আপনি অবশ্য কখনো জানতে পারেননি
আর জানবেন কী করে
কখনো তো সাহস করে বলা হয়নি


একবার দীর্ঘ সময় ছুটির পর
কলেজ খোলার প্রথম দিনে
খুব অস্থিরতায় আপনাকে দেখতে যাই
আপনার অফিস কক্ষে
তখন খুব সাহস করে বলতে চেয়েছিলাম
বুকের কন্দরের ভাঁজে লুকানো অভিসার কথা ;
আমাকে দেখেই ঢুকবার অনুমতি দিলেন
তারপর হঠাৎ আপনার অনামিকায় চোখ পড়ল
এরই মধ্যে আপনি যেনো কী কী প্রশ্ন করলেন
আমি তার কিছুই শুনতে পাইনি
মনে হলো ভরা শ্রাবণে পথ না পেয়ে
উজানি জল সাংঘাতিক এলোমেলো  
আপনি কোনো সাড়া না পেয়ে
আমার দিকে চেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন
সম্ভবত: বুঝে নিলেন আমার চোখের ভাষা
তখন পরিবেশ বদলাতে আপনি
খুব জোরে হেসে ফেললেন; আর বললেন :
কাল থেকে আরো কিছু দিন ছুটি নিচ্ছি
আর সামনে তোমাদের পরীক্ষা
প্রয়োজনীয় সাজেশন দিয়ে দেবো;


তারপর যতবার দেখা হয়েছে
উচ্ছলতা নিয়ে কারণে অকারণে ক্লাসে
কোনও প্রশ্নের উত্তর জানতে
আপনাকে অযথা বিব্রত করিনি
সমুদ্র তরঙ্গ হাসিটা চুপসে গিয়েছিল একেবারে
আপনি খুব খেয়াল করেছিলেন এসব
কিছু দিন পর কলেজের মধ্য মাঠে একা পেয়ে বলেছিলেন :
মানুষের সব চাওয়া কখনোই পূরণ হয় না
সে-ই আপনার সাথে একতরফা নীরব কথন পর্ব সমাপ্ত
অথচ মনের কোণে আপনার-
উঠতি বয়েসের যৌবন ভরা মুখখানি
দীর্ঘ কুড়ি বছর কারণে অকারণে ভেসে ওঠেছিল
তবুও সাহস করে আর কোনো দুঃসাহসি হতে চাইনি
আজ হঠাৎ স্টেশনে দেখে-
সেই পুরনো লজ্জার লীলাবতী রেশ ধরে; কথা বলছি যখন
তখন আড় চোখে দেখছি খুব স্বাভাবিক আপনি
বললেন : যে এসেছিল সে একা করে চলেও গেছে
মাঝখানে দিয়ে গেছে কেবল আধফোঁটা ফুলকলি


শোনামাত্রই, এতদিনের অজানা অভিমান
ঝরে গেলো আমার অজান্তেই
মনে হলো আমিও পেরিয়ে এসেছি অ-নে-কটা পথ
যে দিন এ ঘরের দরজাটি ছিল খোলা
সেদিন আপনি বন্ধ করেছিলেন ওদিকেরটা
আর আজ বন্ধ আমার এ ঘরের দরজা
অধ্যাপক নির্মল চৌধুরী
এ-ই মানুষের জীবনের সরল অংক
জটিল রূপে থাকে।