আমার মরণ  নাই,
মরণ আমাকে চিনে না বাপু; চিনে না।
চোখের উপর দিয়ে কত
বালক বালিক,যুবক যুবতী,বৃদ্ধ বৃদ্ধা চলে গেল ওপারে,
মারা গেল আমারই গর্ভের দু দুটা শিশু।
অথচ আমি শ্মশানের পোড়া কাঠ হয়ে
শ্মশানেই পড়ে আছি,
সেই যে পড়ে আছি,তো আছি-ই।
না পোড়ে অঙ্গার হই,না পোড়ে  হই শুন্য!


মরণ নাকি আমাকে চিনে না!
মরণ নাকি আমাকে  ছুঁয়ও না,,,!!
আমার হাতের লাঠিটা দিয়ে পিঠিয়ে পিঠিয়ে
তাই   ঘর থেকেই বের করে দিয়েছে।
যার যমের ঘরেই স্থান হয় না, তার স্থান
পুত্রবধুর ঘরে কীভাবে হয়?
না হয় না।
যেভাবে হয় নি আমার মায়ের,
কিবা তারও মায়ের মায়ের।


পাড়াপ্রতিবেশিরা বলে,,,
তোমার মরণ নাই গো ঠাকুরমা,
মরণ নাই!!
তোমার লাগি করবী গোটাও নাই!!
অথচ ওরাই একদিন বলেছিল
তোকে বাঁচতে হবে কুমতি, বাঁচতে হবে।
মুক্তি সংগ্রামে চোখের সামনেই যেদিন
স্বামীটাকে  পেয়েছিল মরন,,,
সেদিন আমার কচি হাতের কচি শাখাগুলো
ভেঙ্গে ভেঙ্গে ওরা তাই বলেছিল।
সদ্য পিতৃহারা ছেলে দুটির মুখ দেখিয়ে বলেছিল
ও-লো অভাগী এই দুটি চানের ঠুকরোর লাগি
তোরে বাঁচতে হবে,বাঁচতে হবেই।
কপালের সিঁদুর  নিয়ে গেছে ভগবান,
লাল শাড়িটা  সাদা রঙে দিয়েছে ঢেকে,
তাতে আর কী হয়েছে লো পোড়া-কপালী?
নয় মাসের পেটটা কী আর মিছে?
এই পেটের জন্যেই যে তুই যাবি না মরণে।


আমি বাঁচলাম,
হ্যা হ্যা খুব ভাল করেই বাঁচলাম।
নিজের জীবনের সমস্ত সুখ, দু:খ,বেদনা গুল
বিসর্জন দিয়েই আমি বাঁচলাম।।
শুকুনের পালের সম্মুখে চন্ডিকা রূপ নিয়েই বাঁচলাম।
বাঁচলো আমার ঘর,আমার আঙ্গিনা,আমার জমি,
বাঁচলো বাতাস,আকাশ আর এ পৃথিবী।
তবে বাড়ল কেবল আমার স্বপ্ন,,,,!!
গজালো শেকড়, শুন্য লতার মত উড়লো শুন্যে!!
বাচ্চাগুলোর স্কুলের ব্যাগের ভিতর আমার স্বপ্ন,
ওদের টিফিনের বক্সে আমার স্বপ্ন,
জুতার ফিতে বাধাতে  আমার স্বপ্ন।
ওদের ছেড়া শার্টগুলি
রাত জেগে সেলাই করাতে আমার স্বপ্ন।
স্বপ্নের পথে পথে আমার জীবন দেখে দেখে
লোকে বলল,তুই নারী না; দেবী দুর্গা।
ঘরে লক্ষ্মী, মাঠের রণাঙ্গিনী কালিকা।


সেদিন কথাটার অর্থ বুঝি নিরে বাপু।


আজ বুঝেছি ,,,,,,,,,
ভালো করেই বুঝছি!!
আমি নারী না!!
না, না,না আমি নারী না!!
আমি সুর হতে পারি অসুর হতে পারি,
কিন্তু মানুষ হতে পারি না; কখনো না।


আর তাই সাত বছরের অনাথ শিশু হয়েও বেঁচেছিলাম,
তিন বছরের ছোট্ট ভাই শ্রীধামের জন্যে।
ষোল বছরের দেহ টা নিয়ে বেঁচেছিলাম, স্বামীর জন্যে।
অত:পর নাক ফুল,হাতের চুড়ি,পায়ের আলতা
অকালে হারিয়েও বেঁচেছিলাম
তিনটি সন্তানের স্বপ্নের জন্য।


আমার জানা ছিল না,
বিশ্বাস করো আমার জানাই ছিল না,
ওদের স্বপ্নের সাথে আমার স্বপ্নটার কোন মিলই নেই।
আমার জানা ছিল,
ওদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার,ব্যারিস্টার  হবার স্বপ্ন।
এক্কেবারে নাড়িতে নাড়িতে বাধা ছিল তা,,,
কিন্তু জানা ছিল না
ওদের আলাদা একটা জগত আছে,,,,
যেখানে বৃদ্ধ মায়ের কোন স্থান নেই,,,!
যেখানে বৃদ্ধ মায়ের কোন খাবার নেই!!
যেখানে বৃদ্ধ মায়ের কোন পোশাক নেই!!!
নেই সামান্য মা মা ডাক শুনার অধিকার!!!!
নেই নিজের পুত্রকে পুরোনো অভ্যাসে কিছু একটা বলার!!!!


শাসন, বারণ করবার সাহসতো হারিয়েছি,,,
সেই কবে।
তবু নিজ হাতে মুখে তোলে খাওয়ানুর শখটাকে যে
কোন ভাবেই মারতে পারি না।
মারতে পারি না, ঘুমের মাঝেও বার বার
ওদের চেয়ে চেয়ে দেখার আতংকটা।
আমি মারতে পারি না ওদের পছন্দের সরিষা ইলিশটা
আমার হাতে রেধে খাওয়ানুর সুখটা।
পারি না মারতে ভাঙ্গা চশমা চোখেও
ওদের চোখে মুখে হাসির রেখাটা চিনিতে।
আমি যে এখনো ওদের জন্যে উপোস করি,,
এখনো ঠাকুরের কাছে ওদের জন্যেই প্রার্থনা করি
আর প্রার্থনা করি আমার মরণের।


প্রার্থনা করি সন্তানের গোয়াল ঘরে
অবলা পশুগুলোর সাথে থেকে থেকে,,,,
তবু পুত্রবধুর চোখের মার,হাতের মার সহে গেলেও
মুখের মার সহে না প্রাণে।
সহে না ত্রি কুপুত্রের স্মৃতি আমার বুকের দুগ্ধ জুরে,,,
উদর টা আমার এত খারাপ জানলে
স্বামীর সাথেই সতীদাহ হয়ে
বুঝিয়ে দিতাম আজকের সকলকে,,,,,


মরণ আমাকে না চিনলেও
আমি চিনি মরণকে।
--------------------------------------------------------
রুবেল চন্দ্র দাস
প্যারিস
২৫/০৭/১৭