গ্রামের দশজন মিলিত হয়েছে, করেছে তারা পণ
একটা বিহিত হতেই হবে, নইলে বাঁধিবে রণ।
জমির গাজী হাঁকিছে গল- শোন সব জনগণ
এদের আচরণে বিষিয়ে উঠেছে হায়, জনমন।
রাতের বেলা কিসের কথা আহাদের সাথে কন?
যুবতী মেয়ের এই বয়সে এ কেমন আচরণ!


আহাদ যুবা, তবু তার নাই কিছু দোষ
সিতারার 'পরে পড়েছে সকলের রোষ।
যুবা ছেলে দু'চার কথা বললে কিবা হয়
কিন্তু যুবতী মেয়ের বিচার হইবে নিশ্চয়।


সকলের উৎসুক দৃষ্টি সিতারার 'পরে
কেউ বলে করা হোক তারে একঘরে।
কিন্তু সবার উপরে ছাপিয়ে উঠেছে জমির গাজীর গলা
'শোন মিয়ারা, উচিত বিচার হইবে আজি
রক্ষা পাবে না সিতারা।'


শুনিয়া সিতারার বুক ফাটিয়া যাইবার চায়
বিনা দোষে তার মাথায় চাপিল এ কোন অন্যায়!
আহাদ তখনো নিরব কোন কথা নাহি কয়
শুধু দু'চোখ বাহিয়া অশ্রু ঝরিতে রয়।


হাঁকিল আবার গাজী, বিহিত করিতে হবে আজি
না হয় সন্মান বলিতে কিছু নাহি থাকিবে বাকী
সকলে গুঞ্জন করিল, ঠিকই বলেছে গাজী
এদের জন্য গাঁয়ের সন্মান হারাবো নাকি আজি।


সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিল মজলিশে
সিতারারে একশ দোর্রা দেবার হুকুম হলো সালিশে।
সিতারা বিলাপ করিল, এ কেমন অবিচার!
বিনা দোষে মোরে দিল দোর্রার মার।
আহাদ তখনো নির্বাক রয়
দেখিতেছে শেষতক কি হয়।


দোর্রা মারার জন্য উদ্বত হয় হানিফ কাজী
সকলে বলিল উচিত বিচার হয়েছে আজি।
কিন্তু আহাদ গর্জিয়া উঠিয়া শুধাইল সবায়
সিতারারে দোর্রা মারা হবে ঘোরতর অন্যায়।


বলেছিলাম কথা একলা দু'জনে গহীন ক্ষণে
তবে কেন একা সিতারা খাবে মার অকারণে?
দিতে হয় সাজা আমারেও দাও তাহার সনে
নইলে উচিত বিচার হইবে কেমনে?


কলগুঞ্জন উঠিল তখন জনমনে
এইসব কথা আহাদ কয় অকারণে।
গাঁয়ের দশজন বিচার করেছে মজলিশে
এখন দেখছি শেষতক নিতে হবে এজলাসে।


কেন যুবতী যুবার সাথে কথা কয়
কথার মাঝে কে জানে কত কী হয়?
শুধুই কথা বললে তবুও রক্ষে হয়
কিন্তু কথার মাঝে ও কত কী লুকিয়ে রয়।


অন্ধকার ঘর নিভু নিভু বাতি সুনশান চারিপাশ
কে জানে এই অন্ধকারেই হয়েছে কত না সর্বনাশ!
নইলে কী আর অন্ধকার ঘরে যুবা ছেলেরে ডাকে
এদিকে বাতি ও নিভে গিয়েছিল এক ফাঁকে।


তিমির রাতে অন্য কিবা থাকতে পারে কন?
শাস্তি একে পেতেই হবে দশজনে করেছে পণ।
দ্বিধায় পড়েছে তখন জনগণ
কি করিবে তারা বিদ্রোহ করেছে মন।
সিতার যদি সাজা পায়, আহাদ কেন বাদ যাবে?
সাজা দিলে দু'জনারে দিতে হবে।


জটলা দেখে এগিয়ে এলো রহিম মাস্টার
জানতে চাইলো সবিস্তারে কি হয়েছে ব্যাপার।
- শুনিয়া মাস্টার কতক নীরব রয়
সিতারা তাহার পানে চাহিয়া করিল বিনয়।
বলিল মাস্টার, 'কে দেখেছে আহাদ যাইতে সিতারার ঘরে
সবাইকে বল সবিস্তারে।


সগীর মুন্সী বলিল, 'আমি দেখেছি দুইজনে কথা কয়'
-কথা বললে পাপ হয়, এই কথা কে কয়?
জমির গাজী হাঁকাল গলা- 'আমিও বলি মিয়ারা
কথা বলিলে কী হয়, কিন্তু কুকথা বলিলে পাপ হয়'।


মাস্টার শুধাল, আহাদ বাবা তুমি বল আসল ঘটনা
সকলে যাহা বলিতেছে আমি মনে করি তাহা রটনা।
-'মায় আমার হাঁপানী রোগী একথা জানে সবাই
মায়ের জন্য সিতারার ঘরে ছাগদুগ্ধ আনতে যাই'।


কিন্তু রাতে কেন? জনমনে প্রশ্ন জাগে
-'দিনের বেলা আনতে পারতে' বলিল জমির রেগে।
অসুখ কী বোঝে, রাত আর দিন মানে?
কখন কাহারে ধরে কে তাহা জানে।


আহাদ বলিল, হাঁপানীর ছোটে মায় আমার
জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বলিল বারবার
-' আহাদ বাপ আমার সিতারার কাছে যা
আমার জন্য ছাগদুগ্ধ নিয়া ঘরে ফির'য়া'।


সাত পাঁচ না ভেবে দৌঁড় দিলাম গহীন অন্ধকারে
পড়িলাম গিয়া সিতারার ঘরের 'পরে।
-'মায় আমার মরে হাঁপানীর ছোটে
তোমার কাছে এসেছি ছাগদুগ্ধ যদি কিছু জোটে'।
তেমনি ক্ষণে সগীর মুন্সী দিল প্রকৃতির ডাকে সায়
দূর থেকে দেখেছিল কথা বলিতেছে যুবতী যুবায়।


এই না ব্যাপার! তার লাগি খাবে সিতারা দোর্রার মার
সালিশের নামে এ কেমন অবিচার?
কাঁচুমাচু মুখে লুকায় সবায়, একজন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়
শুধাল মাস্টার, 'কিগো মা বেলা যে বয়'।
নত মস্তকে শুধাল সিতারা, 'জন্ম আমার আজন্ম পাপ
নইলে কী আর জন্ম নিতাম হয়ে অবলা!
এই সমাজে পুরুষের কোন দোষ নাই
দোষ কেবল নারীদের বেলা।'


রুবু মুন্নাফ
১৭-০৯-২০০৬
দক্ষিণ রায়পুর, লক্ষ্মীপুর।