"চল্লিশ বসন্ত" প্রতিশ্রুতিশীল কবি আবু কওছর এর প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশকাল অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২ ইং।
গ্রন্থের নাম কবিতা "চল্লিশ বসন্ত" এ কবিতায় চল্লিশ পেরোনো এক তারুণ্যের আশা হতাশা, চড়াই উৎরাই, শৈশব কৈশোর যৌবনের, যাপিত দিনপঞ্জি প্রকট হয়েছে।কবির মানস কল্পনায়, আটপৌরে জীবন পরিক্রমার, এক নিপাট সরল, অকপট বিবৃতি এই কবিতা।
কারো আত্মজৈবনিক ক্রিয়া কর্মের মলাট উন্মোচন, খুব সহজসাধ্য নয়, জীবন সরল-গরলের এক মিশ্র মদিরাসক্ত মাতালের মাতলামি, আঁতলামি আর চেতন অবচেতনের সাপলুডু খেলা।
এতে আত্মপক্ষ সমর্থন স্বভাবিক, নিজের বিপক্ষে সাক্ষী দেবার ভয়ে অনেক কিছুরই রাখঢাকও অস্বাভাবিক নয়।
বইয়ের মোড়ক খুলে পড়তে পড়তে, এগুলেই আমরা পেয়ে যাই গ্রন্থের স্বনামে উক্ত এই কবিতা। এটি পাঠ করে যেকোন পাঠকই নিজের সঙ্গে নিজের মোকাবেলার, হিমালয় শৃঙ্গ সমান- উচ্চতার, ভীতি ভেদ করবার সাহসী প্রত্যয় বোধ করতে পারেন!
চল্লিশ বসন্ত কবিতার গভীরে কবি আমাদের আরো জানাচ্ছেন, বেনামী সেই তারুণ্যের সংগ্রামের ইতিকথা:-
গাঁয়ের স্কুলের মাষ্টার মশাই বলেছিলেন: আগে লেখাপড়া তারপর নড়াচড়া/ সুতরাং গুরুবাক্য শিরোধার্য মেনে নড়াচড়াহীন বিস্তর লেখাপড়া হয়েছে। এরপর মায়ামৃগ শিকারে বেড়িয়ে সে দেখে স্বপ্নের সোনার হরিণী পালিয়েছে আর ধরা দেয়নি।
সৌভাগ্যবশত: বাপের প্রচুর জমি জিরাত আর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য হওয়ায়, লগ্নভ্রষ্ট এই ভাবুক কে অন্নকষ্টের মুখে পড়তে হয়নি। মৌমাছির মাধুকরীর মত জীবন ও জীবিকার তাগিদে, কর্মভিক্ষা করে আর কর্মী নিয়োগ বোর্ডের হর্তাকর্তাদের, হাঙর মুখে ঘু্ষ উৎকোচ দাবির, বিষাক্ত কামড় খেয়ে, বিস্তর ক্ষত বিক্ষত হয়েও যখন কিছুতেই আর কিছু হলোনা, তখন হাল আর পাল ছেড়ে,হতোদ্যম হয়ে পড়া সে তরুণের "কর্মই জীবনের ধর্ম" এমনটি জানা থাকলেও আর মানা সম্ভব হয়নি।
অর্জিত সকল শিক্ষা ঝুলিভর্তি রইলো, কর্মদীক্ষা যখন হলো না? শুরু হলো নির্মোহ মনে উদ্যেশ্যহীনভাবে গ্রাম্য পাকদণ্ডি রাস্তাঘাটে পদচারণা, কিংবা কাজে অকাজে স্কুটারে চড়ে বেড়ানো।
আমরা যদি আন্দাজে এই তারণ্যের দিনলিপি কবির ব্যক্তিক যাপনের অনুষঙ্গ হিসেবে ধরে নেই? তবে বলতে পারি এই উদ্দেশ্যহীন পর্যটন শেষমেশ সুপ্ত কবি প্রতিভার বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে! সবুজ প্রকৃতি বনবনানী, গ্রাম্য জলাশয়, শুখা নদী হাওর বাওর, পাখপাখালি, মানুষের কোলাহলের, সঙ্গে নিজের আত্মা আর সত্তার, আত্মীয়তা অনুভব করে শুরু হলো কবিতায় তার অনবদ্য প্রকাশ।


আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে সূচিবদ্ধ হয়েছে কবির ভিন্ন ভিন্ন মেজাজের মোট ৪৬ টি কবিতা, পরিবেশ প্রতিবেশ, প্রেম ভালোবাসা, মিলন বিরহ, ছলনা চাতুরি, শটতা কপটতার, মুখোশ উন্মোচন, সামাজিক বিধিবন্ধন, ক্ষমতা অক্ষমতা, আশা নিরাশা, উদ্যম হতাশা, আস্তা অনাস্থা, সংশয় সন্দেহ, দারিদ্র দৈন্য বিত্ত বৈভব, স্বপ্ন-বাস্তবতা, সবকিছু মিলিয়ে, মানবীয় হৃদয় বৃত্তির, চেতন অবচেতনের লীলা বৈচিত্র্য কবি কল্পনার, আরশিতে প্রতিবিম্বিত প্রতিসরিত হয়েছে, বহুবর্ণ আলোকচ্ছটায়।
গ্রন্থের সুচনা কাব্যের শিরোনাম: "কলম সৈনিক"  মুলত কবিরাও এই সৈন্যদলের অগ্রগামী সদস্য, সৈন্য বলতে আমরা সড়কি বল্লম, আগ্নেয়াস্ত্র গোলাবারুদ, বিস্ফোরক বহনকারী, সামরিক পোশাকধারীদের বুঝি।
কলমে গোলাবারুদ না থাকলেও কলমের তরল, নিরীহ কালি, কলম সৈনিকের বিপ্লবী চিন্তা চেতনার স্ফুরণ বিস্ফোরণ ঘটায়, সুতরাং কলমধারিও সৈনিক। তার এই অস্ত্রচালনা সবসময় সরল রৈখিক নয়।
মাঝে মাঝে উল্টোপথেও আঙ্গুলের ইশারা ফাঁকি দিয়ে কলম চলে।
লেখনির জড়ায়ু ফেটে, কাগজের বুকে ফুটে উঠে, কবি কল্পনার মানস সরোবরের শতদল পদ্ম। এ থেকে জন্ম নেয় সহস্রদল পদ্ম। কবিতার শেষ চরনে তাই কবির উক্তি: কলম সৈনিক মরেনা কখনো নাহি শ্রম বিফলে!
"প্রত্যাশা" শিরোনামা কবিতায় সুন্দর সুন্দর আশা জাগানিয়া কথামালা উক্ত আর ব্যক্ত হয়েছে, গ্রাম বাংলার চিরচেনা পাখি ডাহুকের উপমা কল্পচিত্রে- রক্তরাগি ডাহুকের কন্ঠে/ মুখরিত জনপদ সকাল দুপুর সাঁঝে/ সঙ্গীনির মিলন প্রত্যাশায়, ডাহুক যখন অবিশ্রাম ডাকে, তখন তার গলা ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে, তাই কবির কাছে সে রক্তরাগি।
মানুষ ও প্রাণিকূলের অবধারিত পরিণতি মৃত্যূ, এর মাঝে অপমৃত্যুর দানব  হাত প্রসারিত হয় মাঝে মাঝে, মানুষের কর্মদোষে, কিন্তু মানুষ স্বয়ং স্বয়ম্ভূ স্রষ্টাকে ভাবে নিষ্ঠুর প্রতিপক্ষ?? 'ক্ষনিক স্বার্থে ভুলিয়া অঙ্গীকার' খতিয়ে দেখেনা নিজের ভুলচূক?
"কে বলে পৌরানিক" কবিতায় কবির সখেদ স্বীকৃতি: কবি হতে আসিনি এ-পাড়ায়/ এসেছি তোমাদের ভণ্ডামি নষ্টামির স্বরূপ উন্মোচক হয়ে, কালিভরা অস্ত্র নিয়ে/ সান দেওয়া তলোয়ার আর সমরাস্ত্র অত্যাধুনিক/কলমের কাছে খাবি খায় সবি/যুগের পর যুগ রয়েছে প্রমাণ।
কলম যে সাক্ষাত "ব্রহ্মাস্ত্র" এই কবিতার ছত্রে ছত্রে কবি এর যৌক্তিক জোরালো প্রমাণ দিয়েছেন।


"আপনি কেমন আছেন" শিরোনামা কবিতার সরল তর্জমা হলো: স্বাভাবিক কুশল জিজ্ঞাসার জবাবে, যে উত্তরটা আমরা সচরাচর দেই, অবলীলায়, তা হলো: ভালো কিংবা খুব ভালো আছি/ বুকের ভেতর ছাইচাপা অগ্ন্যুদগিরন চেপে রেখেও ভালো আছি নামক, ভাব ভণিতা! এই ভাব ভণিতার মুখাভিনয় কি আদৌ সত্যি?? আমরা কি বুকে হাত দিয়ে, সকলে এর সত্যতার সাক্ষী দিতে পারি? এজন্য কবির পাল্টা প্রশ্ন, অন্তত একটিবার মন থেকে বলুন / আসলে আপনি কেমন আছেন?/
"মানুষ" শিরোপাদির একটি কবিতা রয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে, এতে দেখতে পাই কবি প্রশ্নাকারে লিখছেন: আমাতে কি আছি আমি/ সব জানে অন্তর্যামি/ ঘুরিয়া নানান পথ-চড়িয়া নানান রথ/ মুখ আর মুখোশ দেখে, মানুষ চেনা দায়/ আসলে মানুষের সবটা মানুষ নিজে জানেনা। সুতরাং সে কেমন আছে? এর উত্তর তার নিজেরও অজানা!!
অতঃপর "স্বরূপে অরূপে" নামধারী অন্য আরেকটি কবিতার শুরুতেই কবি বলছেন: যা ভেবেছ তা নয় আমি/ যখন যেমন থাকা তেমন/ সাদা কালো ক্ষনিক আলো/ কান্না লয়ে হাসি/ কালের বেলা এড়িয়ে চলা/ লুকিয়ে ঘৃণা বাজাই বীণা সকল ভালোবাসি/ পূর্বোক্ত কথায় কবিতায়, মনুষ্যত্বের যে অচেনা অজানা গলি ঘুপচির, রহস্যময় শুলুক সন্ধানের প্রয়াস ও গ্লানি ব্যর্থতা, তা একেবারে দুর করে দিয়েছেন কবি, বর্ণিত কবিতায়। আমার মনে হলো এই কবিতার একটি পংক্তিতে স্বরূপে-অরূপে যে স্বর্গীয় মুচকি হাসির বিনিময়! এখানেই অজ্ঞেয় অজ্ঞাত, মানবাত্মার মুখভঙ্গির সরল প্রকাশ ঘটেছে। সহজ সরল সত্যকে ভালোবাসতে পারাটাই, মানব জন্মের স্বার্থকতা।
"চাইনি মাগো" কবিতায় এই সত্যনিষ্টা সত্যবাদিতা, ও ভালোবাসার পক্ষপাত আরো প্রকট হয়েছে, বর্ণিত পংক্তিতে কবির প্রতিজ্ঞায়:চাইনি মাগো আকাশ ছুঁতে/
বিত্ত বৈভব বিলাস জীবন/ চাইনি মাগো শিল পাথরে/ মাথা ঠুকে স্বেচ্ছা মরণ/ চাইনি মাগো রাজা হতে/ কেড়ে নিতে ভুখার খাবার/  যা আছে মা সেখান থেকে/ ইচ্ছে জাগে বিলিয়ে দেবার/ চাইনি মাগো ধার করা জ্ঞান/ চুরি বিদ্যায় উৎরে যেতে।
কবির বিবেচ্য উৎরাই এবং উত্তরণ হবে সত্য ও সৎপথে, কোন চাতুর্য্য বা নিষ্ঠুর খল পন্থায়, পরের স্বার্থঘাতী হয়ে নয় বরং পরের হিতাকাঙ্খায়, নিজের সমুহ বিলিয়ে দিয়েই, জীবনের বৈতরণী পেরিয়ে যাবার শিক্ষাও দীক্ষা নিতে আমাদের উদ্ধুদ্ধ করাই কবির লক্ষ্য।
সর্বোপরি আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে আরো বহু বিচিত্র, ভিন্ন ভিন্ন মেজাজের বাণীও  আমেজের কবিতামালা রয়েছে।
একটি কাব্যগ্রন্থের সামগ্রিক কবিতার ভাবরস, নিংড়ে নেওয়া কোনও পাঠক সমালোচকের পক্ষে সহজসাধ্য নয় মোটেই। আর কবিতার শরীরে যে শব্দবন্ধ ও ছন্দের হীরকখণ্ড থাকে, তার আলোক বিচ্ছুরণ দেখা, সংবেদনশীল মনস্চক্ষু ছাড়া মোটেই সম্ভব নয়।


আমি চর্মচক্ষু দিয়ে কবিতাগুলো পাঠ করেছি এর যতটা বিকিরণ আমার মনস্চক্ষে প্রতিসরিত হয়েছে, আমি তার যৎসামান্য ভাব বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছি মাত্র।
আমি এই আলোচ্যগ্রন্থের পাঠকপ্রীতি ও বহুল আলোচনা কামনা করি। এবং আশাকরি এটি ভবিষ্যতে পাঠক সমালোচকের নিকট আদরণীয় হবে, এর  যথাযোগ্য সারাৎসার, আলোচনা সমালোচনা হবে, আগামীর সময় পরিক্রমায়।


সবশেষে বলা যায় সৃজনশীলতার ভুবনে আলোচ্যগ্রন্থ প্রণেতা, এক ক্রম অগ্রসরমান সৃষ্টিশীল মানুষ।
আলোচিত কবির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:-
কবি, প্রবন্ধিক আবু কওছর ১৯৭২ সালে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী দাওরাই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম হাজি আব্দুল হান্নান ও মাতা মরহুমা জামিলা খাতুন। সাবেক শিক্ষক, বর্তমানে একজন ব্যবসায়ী, এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত। সৃজনশীল সাহিত্য সাময়িকী আলোকিত দাওরাই তাঁর সম্পাদিত একটি নিয়মিত ত্রৈমাসিক প্রকাশনা । প্রকাশিত যৌথগ্রন্থ- ১. সঞ্চয়ন, ২. ছোট পাখি, ৩. রাতের জ্যোৎস্না, ৪ কাব্য ভাষায় মহামারি করোনা ভাইরাস, ৫. অভিযাত্রি, ৬. বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা, ৭. স্বাধীনতার মহানায়ক শেখ মুজিব, ৮. হাওর পাড়ের কাব্য, ৯. সাহিত্যের কুসুম জ্যোতি, ১০. কবিতা সংকলন কাব্য । সম্পাদিত গ্রন্থ : ১. বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা, ২. স্বপ্নের ফেরিওয়ালা ও ৩. স্বপ্নের ঠিকানা, কবি সাদিকুর রহমান রুমেন এর সঙ্গে তার যৌথ সম্পাদিত গ্রন্থ(কবি গবেষক দীনুল ইসলাম বাবুলের জীবনও সাহিত্যের মুল্যায়নধর্মী আলোচনা গ্রন্থ)স্বদেশের মুখ।


আলোচকঃ
মোঃ সাদিকুর রহমান রুমেন,
কবি লেখক ও বিশ্লেষক।