জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় শৈশব ও কৈশোর কেটেছে আমার গ্রামে।
আমার গ্রাম থেকে দেখা যায় উত্তরের গারো পাহাড়,
মেঘালয়ের পাহাড়ের পাশে,
নীল আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে আজীবন দাঁড়িয়ে আছে।
পাহাড় থেকে নেমে আসা
সুমেশ্বরী নদীর শাখা নদী গোমাই ও সিদ্ধলা এ দু’টি নদী
আমার গ্রামসহ দশটি গ্রাম ও ফিলুয়ার বিলকে
চারিদিকে ঘিরে আছে।
আরো কিছু খাল, নদী-নালা যুক্ত হয়েছে এ বিলের সাথে।
বর্ষায় সমস্ত বিল হয়ে উঠে এক বিশাল জলরাশি,
মাঝি ডিঙি নিয়ে বিল পার হতে ভয় পায় তখন।
মৌসুমি বায়ুর প্রচন্ড আঘাতে পাহাড় সমান ঢেউ উঠে বিলে।
সারা বছর জেলেরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে।
এদের বসবাস বিলের পাড়ের গ্রামগুলো ঘিরে।
বছরের ছয় মাস পানিভর্তি থাকে তাতে,
চাষীরা ধানের চাষ করতে পারে না বিলের তলাতে।
পৌষ-মাঘ মাসে কোন চাষ ছাড়াই বোর ধান রোপণ করে তাঁরা।
তিনমাস পর চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রচুর ধান ঘরে তুলে চাষীরা।
মাছ ও ধানের ভান্ডার বলে অনেক ডাক-নাম তার,
এ ছাড়া তার চারপাশে চারণভূমি বিশাল আকার।
তার পশ্চিম পাড়ে শ্যামপুরের হাট বসে বৃহস্পতি ও রবিবার।
আমি কৈশোরে কোন না কোন ছুতা ধরে গিয়েছি সে বাজার।
শুকনো মৌসুমে গিয়েছি দক্ষিণ-পশ্চিম পাড় ঘুরে,
চারণভূমির মেঠোপথ ধরে, রাখালের সাথে খেলা করে করে।
বাজারের কিছু টাকা বাঁচিয়ে কিনেছি বাদাম আর নাড়ু।
বিলের পুর্বপাড়ে আমাদের বাড়ি,
মাথায় আছে, সন্ধ্যার আগে দিতে হবে বিল পাড়ি,
রাত হলে ধরবে রাস্তায় কানাউলা, যেতে পারবনা বাড়ি।
রাস্তায় পরে বটগাছ, হিজলগাছ, কালিমন্দির ও শ্মশানঘাট,
সন্ধ্যা হলে তাই যে কোন হাঁটুরের সাথে মিশে বাড়ি যাই।
বর্ষায় বিল পাড়ি দিয়ে যেতে হয় শ্যামপুরের হাটে।
বাজারে যাওয়ার সময় হলে, সবাই এসে অপেক্ষা করত ঘাটে।
আল্লাহর নাম নিয়ে খুব সাবধানে সবাই নৌকায় বসে,
বেশি বোঝাই করে লোক নেয়া যাবেনা, যদি বিলে ঢেউ উঠে!
বিলের পশ্চিম পাশে আমাদের বোর জমি ছিল ঢের,
মাঘ মাসে রোপণ করা হত ধানের চারা ফসল হত প্রচুর।
একদিন দুপুরে কামলাদের খাবার নিয়ে রাখলাম তুপায়।
আমি শখ করে গেলাম, কামলাদের সাথে ধানের চারা রোপনে।
কিছুক্ষণ পর সবাই এসে দেখি, খাবার খেয়ে ফেলেছে কে!
বুঝে উঠতে পারল না কেউ, আশ্চর্য! কে খেল খাবার?
সবাই ভয় পেয়ে ভাবি, কিছুই দেখলাম না এটা ভূত না জিন!
খানেক পর এলেন আমার বাবা, অভিজ্ঞ প্রবীণ মানুষ।
সবিশেষ শোনে বললেন, “তোরা সব বেহুশ, নেই কোন হুশ।
তোদের ভাত খেয়ে ফেলেছে ঊঁদে,
দেখিসনা ওরা কত গর্ত করে রেখেছে খুঁদে।
মাঘে, দুপুর হওয়ার আগে গ্রামের যত কিশোর-জোয়ান
সবাই একসাথে দল বেঁধে মাছ ধরতে যেতাম বিলে।
ত্রিশ-চল্লিশ জন পানিতে নেমে এক সারিতে লাইন ধরে,
মাছ রাখার জন্য দড়ি দিয়ে পাতিল বাঁধা আছে সবার কোমরে।
দু’পা ফাঁক করে মাঝে মাটিতে গর্ত করে
একসাথে হাতে পানি টেনে পিছনে, পানিতে শ্রোত সৃষ্টি করে,
মাছদের ডেকে আনা হত ঝাঁকে ঝাঁকে।
মাছেরা গর্ত পেয়ে সেখানে জমা হত ঘোলা জলে খাবার খেতে।
সকলেই দু’হাতে মুঠিভরে মাছ ধরে নিতাম পাতিলেতে।
সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম-
যখন শ্রোতের টানে মাছ লাফিয়ে পড়তো সবার শরীরেতে।
মাছ ধরা শেষে বিলের পাড়ে উঠে লক্ষ্য করে দেখি,
পা থেকে ঊরু পর্যন্ত রক্ত চুষে লাল হয়ে আছে হাজারি পাউট্টা।
ঘাস মুটি করে হাতে নিয়ে অনেক্ষণ ঘষে এদেরকে মারতে হতো।
এরা মানুষের শরীরে ধরে এক মিনিটে বাচ্চা দেয় এক হাজার,
এটি একটি জোঁকের চেয়ে ছোট অদ্ভুত জলজ প্রাণি,
আদিকাল থেকে গ্রামের মানুষ এদেরকে ডাকে পাউট্টা জানি।
চৈত্র মাসে বিলের পানি শুকিয়ে গেলে,
গর্তগুলোর চারদিকে বাঁধ দিয়ে পানি সেঁচে মাছ ধরে নিতাম,
কৈ, শিং, মাগুর ও বোয়ালসহ অনেক জাতের মাছ।
খিদে পেলে ফাঁকে খেয়ে নিতাম সিংরা-হুগল ইত্যাদি পানির ফল।
হেমন্ত-শীত-বসন্ত-গ্রীষ্মে বিলের পাড়ে চারণ ভূমিতে খেলা চলত।
কাঁচা জাম্বুরা আর বনের তৈরি বল দিয়ে খেলা জমত রাখালের সাথে,
আমিও তখন আমাদের গরুর পাল নিয়ে রাখাল হয়ে যেতাম।
কাঁচা আম, জাম, নারিকেল ও কুলসহ নানা রকমের ফল নিতাম।
ঘুড্ডি উড়ানো, বলখেলা, গোল্লাছুটসহ আরও অনেক খেলা খেলতাম।
বৈশাখ- জ্যৈষ্ঠ মাসে কাল বৈশাখীর সাথে বর্ষণ হলে,
চারণভূমির পানি বিলে গড়িয়ে পড়তো ঢলের মত।
সে সময় বিল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে কইমাছ চারণ ভূমিতে উঠে আসতো।
বৃষ্টিতে ভিজে দুর্বাঘাসে চিপচিপে পানিতে কইমাছ ধরতে কী যে মজা হতো!