💄মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ-   আমরা জেনেছি, স্বরবৃত্ত রীতিতে মুক্তদল এক মাত্রা রুদ্ধদলও একমাত্রা কিন্তু  এই ছন্দরীতিতে  প্রতিটি  মুক্তদল একমাত্রা হিসাবে গণ্য হলেও প্রতিটি  রুদ্ধদলকে সর্বদাই দুই মাত্রা ধরা হয় । যেমন,


উচ্চকণ্ঠ= উচ্+চ+কণ্+ঠ= 2+1+2+1= 6 মাত্রা।
রোদ্দুরের= রোদ্+দু+রের্= 2+1+2= 5 মাত্রা।
অন্তহীন = অন্+ত+হীন্= 2+1+2=5 মাত্রা ।
-----'------
পর্ব বিভাজনঃ- আমরা জেনেছি, স্বরবৃত্তে পূর্ণ পর্ব 4 মাত্রার বেশি হয় না কিন্তু মাত্রাবৃত্ত ছন্দে পূর্ণ পর্ব 4, 5, 6 ও 7  মাত্রার হতে পারে । এবার একটা দৃষ্টান্ত তুলে  ধরা যাকঃ-
------
"জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে
ধূসর শূন্যের আজান গান
পাথর করে দাও  আমাকে নিশ্চল
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।"    (শঙ্খ ঘোষ )
---
আমরা জানি, পাঠ অনুসারে যেখানে যেখানে একটুখানি থামি সেটিই হল পর্ব । তাহলে পর্ব বিভাজন করে দেখা যাকঃ-
---


জাগাও শহরের / প্রান্তে প্রান্তরে
ধূসর শূন্যের / আজান গান
পাথর করে দাও  / আমাকে নিশ্চল
আমার সন্ততি / স্বপ্নে থাক।
--
এবার মাত্রা গণনা করা যাকঃ-


জাগাও=  জা(মুক্তদল )+গাও(রুদ্ধদল )= 1+2 = 3 মাত্রা ,
শহরের=  শ(মুক্তদল ) +হ(মুক্তদল ) +রের(রুদ্ধদল ) = 1+1+2 =4 মাত্রা,  


দেখা যাচ্ছে পর্বটিতে মোট 3 + 4 = 7 মাত্রা  আছে।
  অর্থাৎ  এখানে 7 মাত্রার পূর্ণ পর্ব ব্যবহার করেছেন কবি।
-------
প্রান্তে = প্রান্(রুদ্ধদল ) + তে(মুক্তদল ) = 2 + 1 = 3
প্রান্তরে = প্রান্ (রুদ্ধদল ) + ত (মুক্তদল + রে (মুক্তদল )= 2+1+1=4
অর্থাৎ এটিও 3+4 = 7 মাত্রার পূর্ণ পর্ব ।
----------------------------------
ধূসর  = ধূ+সর্ = 1+2=3
শূন্যের = শূন্ + নের্ = 2+2=4,
অর্থাৎ 3+4= 7 মাত্রার পূর্ণ পর্ব ।
-------
আজান  = আ+জান্ = 1+2
গান = গান্ = 2
3+2= 5 মাত্রার অপূর্ণ পর্ব ।
---------------------------------------
পা1থর2 ক1রে1দাও2 (7 মাত্রার পূর্ণ পর্ব )/ আ1মা1কে1 নিশ্2চল্2 (7 মাত্রার পূর্ণ পর্ব )।
------
আ1মার্2 সন্2ত1তি1 ( 7মাত্রার পূর্ণ পর্ব )/ স্বপ্2নে1 থাক্2 (5 মাত্রার অপূর্ণ পর্ব )।
---------------------------------------


-------
অর্থাৎ কবিতাটিতে 7 মাত্রার  পূর্ণ পর্ব এবং 5 মাত্রার অপূর্ণ পর্ব ব্যবহৃত হয়েছে।


         * এই ছন্দরীতিতে বিভিন্ন মাপের  অর্থাৎ 4,5,6 ও 7 মাত্রার  পূর্ণ পর্ব ব্যবহারের সুবিধা নেওয়া যায়।  ফলে আধুনিক কবিতাতেও এই রীতির প্রয়োগ ঘটানো যেতে পারে। তাছাড়া প্রয়োজনে পঙক্তির প্রথমে 4 মাত্রার কম পর্ববিশিষ্ট অতি পর্ব এবং শেষে কম মাত্রার অপূর্ণ পর্ব ব্যবহার করা যেতে পারে ।
-----------
     মাত্রাবৃত্ত রীতির আরও কয়েকটি বিভিন্ন মাপের পর্বের দৃষ্টান্তঃ-
চার মাত্রার পূর্ণ পর্ব --
বরষার /নির্ঝর / অঙ্কিত/ কায়  4+4+4+2
দুই তীরে / গিরিমালা / কত দূর / যায়  4+4+4+2    
স্হির তারা/নিশিদিন/তবু যেন/ চলে 4+4+4+2
চলা যেন/ বাঁধা আছে/অচল শি/কলে(শিকলে)।
4+4+4+2
(কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর )


          * (কবিগুরুই এই "মাত্রাবৃত্ত" ছন্দরীতির আবিষ্কারক। যদিও প্রাচীন কালে চর্যাপদসহ কিছু কিছু কবিতায় এই রীতির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু সেগুলি ছিল নিতান্তই অসচেতন প্রয়োগ। রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম এই রীতিকে সুনির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধেন।)
------------------------------------
পাঁচ মাত্রার পূর্ণ পর্ব --
রোদ্দুরের / আঙুলে আঁকা /   5+5
মেঘের চেরা / সিঁথি  5+2  
হঠাৎ খুলে / দিল স্মৃতির /   5+5
অন্তহীন ফিতে      5+2  (বুদ্ধদেব বসু)
-----------------------'-------------
ছয় মাত্রার পূর্ণ পর্ব --
হে মহাজীবন / আর এ কাব্য / নয় / 6+6+2
এবার কঠিন / কঠোর গদ্যে / আনো 6+6+2
পদলালিত্য / ঝঙ্কার মুছে/ যাক/    6+6+2
গদ্যের কড়া/হাতুড়িকে আজ/হানো  6+6+2
                       (সুকান্ত ভট্টাচার্য )
---
বন্ধু গো আর / বলিতে পারি না / বড়ো বিষ-জ্বালা/এইবুকে,  6+6+6+4
দেখিয়া শুনিয়া /ক্ষেপিয়া গিয়াছি/তাই যাহা আসে/কই মুখে,  6+6+6+4     (নজরুল ইসলাম )
---
আঠারো বছর বয়স ভয়ংকর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা (সুকান্ত ভট্টাচার্য )


আঠারো বছর/ বয়স ভয়ং/ কর  6+6+2
তাজা তাজা প্রাণে/ অসয্ য যন্/ ত্রণা 6+6+2


*(লক্ষ্য করুন, 'ভয়ংকর' ও 'যন্ত্রণা' ভাঙা হয়েছে পূর্ববর্তী পর্বের মাত্রা ঠিক রাখতে । উচ্চস্বরে পাঠ করে দেখুন, ভয়ং- ও যন্- এর পর যৎসামান্য হলেও থামতে পারি । রবীন্দ্রনাথও যেমন ভেঙেছেন "শিকলে" শব্দটি)
-------------------------------------
সাত মাত্রার পূর্ণ পর্ব --
শ্রাবণে সন্ধ্যায় / অঝোর মায়ালোকে 7+7
চাই নে উজ্জ্বল / তোমার মুখচোখ  7+7
               (অরুণকুমার সরকার )
---
এ শুধু ছায়াছবি,/ পুকুরে ঢিল ছোঁড়া,   7+7
বাতাসে খসে পড়া / পাতার নিস্বন ;    7+7
এ শুধু সন্ধ্যার / সোনালি ফুলঝুরি,     7+7
ফুলের গন্ধের / যৌন আবেদন।        7+ 6
                   ( বুদ্ধদেব বসু )


💄"প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
   ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা
   চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
   কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া ।"
       -(পদাতিক,  সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
*কঠোর বাস্তবের কথাও যে ছন্দবদ্ধ কবিতায় প্রকাশ করা যেতে পারে, এটি তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত ।
-এবার আপনারা এই কবিতাটির পর্ব ও মাত্রাবিশ্লেষণ করে মন্তব্যের ঘরে দেখাতে পারেন।


------------------------------------------


         ** কোন ছন্দরীতিতেই পূর্ণ পর্বের মাপ 4 মাত্রার কম হয় না।


         *** এই রীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল রুদ্ধদলের প্রসারিত উচ্চারণ। রুদ্ধদলের আবার প্রসারিত উচ্চারণ? ব্যপারটা কি? ঘাবড়াবার কিছু নেই । ব্যাপারটা খুবই সহজ। সবই আমাদের স্বাভাবিক উচ্চারণগত তারতম্যের ব্যাপার। যেমন, 'মিষ্টান্ন ' শব্দটির মিষ্ একটি রুদ্ধদল; এটি উচ্চারণের সময় 'মিইষটান্ন'--এরকমতো বলি না। ঝপ করে বলি মিষ্টান্ন। অর্থাৎ 'মিষ্' ধ্বনিটি উচ্চারণকালে উচ্চারণ প্রসারিত করার দরকার হয় না। সুতরাং এখানে  'মিষ্' হল  একটি সংকুচিত রুদ্ধদল ।  কিন্তু  যদি 'উচ্চ' বলি তাহলে সামান্য হলেও টেনে বলি, 'উউচ্চ। একারণেই মাত্রাবৃত্তে  এধরণের প্রসারিত উচ্চারণের রুদ্ধদলসমন্বিত শব্দ চয়ন করা হয়  এবং রুদ্ধদলকে 2 মাত্রা ধরা হয়। উল্লেখিত কবিতাটিতেও রুদ্ধদলগুলি দেখুন, পড়ার সময় যদি আবৃত্তি করার মত করে পড়া যায় তাহলে আরও ভালভাবে বোঝা যাবেঃ-
জাগাআও শহরেএর প্রাআন্ তে প্রাআন্ তরে
ধূসঅর শূউন্যেএর আজাআন গাআন ...
"""""""""""""""""""""""""""""""""""""""""
* একবার মন্তব্য করার পর আরও যদি কোন প্রশ্ন থাকে তাহলে "আপনার মন্তব্য"র ঘরে করবেন প্লিজ, কারণ একটির বেশি "উত্তর দিন" অপশন থাকে না। তাই উত্তর দিতে অসুবিধা হয়।