কবিতার আলোচনায় প্রবেশের আগে খানিকটা শিবের গীত গেয়ে নেওয়া যাক।জগতে এত কিছুর আয়োজন থাকা সত্ত্বেও আজও কিছু মানুষ কেন কবিতা পড়েন? বিশেষত সাম্প্রতিক কবিতা?  সহজ উত্তর, রসাস্বাদনের জন্য। শত শত বছর ধরে দেশে বিদেশে যে অজস্র কবিতা রচিত হয়েছে তাতে কি আর নতুন কোন ভাব অথবা ভাবনার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে নতুন কোন কবিতায়, পাওয়া যেতে পারে নতুন কোন রস? এক, রবীন্দ্রনাথেই তো আজও  রসপিয়াসী মানুষেরা খুঁজে নিতে পারে তাদের কাঙ্খিত যাবতীয় রস।কেবল আঙ্গিকে অথবা প্রকাশভঙ্গিতে কিছুটা নতুনত্বের স্বাদ হয়তো পাওয়া যেতে পারে।আর সাম্প্রতিক ঘটনার উপর রচিত কবিতায় মতামতজনিত বক্তব্য পাওয়া যেতে পারে যা পূর্বজদের কবিতায় পাওয়া যাবে না।
         তবু ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর! যদি কখনও কোথাও মিলে যায় অনাস্বাদিত পূর্ব কোন রস, কোন রত্ন .........।।


------------------------------------
          ধরাছোঁয়ার মাত্রা
------------------------------------
দিন গুনি পলগুলোকে পলকে এক করে,
দিন জমাই এবড়োখেবড়ো বাদ রেখেই।
তবুও গতানুগতিক কিভা‌বে মেলে?
কী জানি!
কত না রকমফেরে দৈনন্দিন তালিকা !!
মিল মাত্র একজায়গায়,
কেউ থাকে না।


রাজসিক সংগ্রাম বা হাটের হেঁটুরে,
যাকিছু গোছ করে গোছাই,
হাতে থেকে সব,
একখন্ড শিলাবৃষ্টির শিল হয়েই,
কখন যে গলে যায়।  
কিংবা বাস্প সেজে মেঘপরীর দেশে,
শুধু একাই আমি পড়ে...
-------------------------------------
* 'বাস্প' বানানটি ভুল আছে, ওটি বাষ্প' হবে।


           প্রথমেই কবিকে কুর্নিশ জানাই কবিতাটিকে "বিবিধ কবিতা" হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য। এতে আলোচকের স্বাধীনতার পরিসর অনেকটাই বেড়ে যায়।


         শিরোনামঃ- মানুষ তাঁর জীবনের  চলমান অথবা ফেলে আসা মুহূর্তগুলির কতটুকু আয়ত্বে রাখে বা রাখতে পারে সেটাই বোঝানো হয়েছে শিরোনামটিতে। বলা বাহুল্য,, সার্থক শিরোনাম।


         ১ম স্তবকঃ-  কবির ফেলে আসা জীবন-পথে কখনও ছিল চড়াই, কখনও উৎরাই আবার কখনওবা সমতল যা সব মানুষের জীবনপথেই থাকে। অতিবাহিত সেই অজস্র মুহূর্তগুলির মধ্যে "এবড়ো-খেবড়ো" অর্থাৎ  বেদনার্ত অথবা অপ্রিয় বা ভুল-করা মুহূর্তগুলি বাদ দিয়ে নিমেষেই সুখকর অথবা গৌরবজনক মুহূর্তগুলিকে  জমিয়ে ফেলেন মনের মণিকোঠায়। অভিজ্ঞতাকে পাথেয় করে ভুলগুলি সংশোধনের মধ্য দিয়ে সামনের পথটাকে এবড়ো-খেবড়ো-রহিত মসৃণতায় বদলাতে চান কবি। কিন্তু কেমন করে যেন সে-ই একই গতানুগতিকতা ফিরে ফিরে আসে! যেন সেই একই রকম দিনগত পাপক্ষয়! যদিও সব দিন একরকম যায় না। কত না রকম ফের! কবি কেবল একটা জায়গাতেই দিনগুলির মধ্যে মিল খুঁজে পান, সেটি হল একাকীত্ব।  কত সুন্দরভাবে চিরন্তন অনুভব ফুটিয়ে তুলেছেন কবি।


          ২য় স্তবকঃ কবি তাঁর জীবনের উজ্জ্বল তথা গর্বের মুহূর্তগুলি (রাজসিক সংগ্রাম), এমন কি ফ্যাকাসে বা মামুলি (হেঁটুরে) দিনগুলির  কথাও জমিয়ে রাখতে চান; কিন্তু কিছুই থাকে না হাতে, কেউ বরফের মতো (শীতল মুহূর্তগুলি) গলে যায় আবার কেউ বা বাষ্প হয়ে ( উষ্ণ মুহূর্তগুলি) উড়ে গিয়ে বিলীন হয়ে যায় মহাশূন্যে( পরীর দেশে)। শেষ পর্যন্ত সেই নিঃসঙ্গ বা একা হয়ে পড়ে থাকতে হয় কবিকে।


             সত্যিই তো একটি মানুষ প্রথমত একা, দ্বিতীয়ত একা, শেষ পর্যন্ত একা।


          ভবিতব্য বা বিধিলিপির কাছে মানুষ কত অসহায় সেই চিরন্তন সত্যের কথা মুগ্ধকর কাব্যিক দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন কবি । অথবা বলা যেতে পারে মানুষের সীমাবদ্ধতার কথা আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিলেন তিনি।


           পাঠক যখন কোন কবিতার মধ্যে নিজেকে দেখতে পান তখন সেই কবিতা তার কাছে বড় প্রিয়, বড় আপন হয়ে ওঠে। এটিও এমনই এক কবিতা।