ফুল, পাখি, চাঁদ, বসন্ত নিয়ে হাজার কবিতা লেখা হয়। লেখা হয় বর্ষার কবিতাও। পাঠক-চিত্ত তৃপ্ত হয় সুখপাঠ্য কবিতা-পাঠে। কবির চেতনার রঙে পান্না হয় সবুজ, চুনি ওঠে রাঙা হয়ে। কবিতার কারু-কার্যতায় মুগ্ধ হয় পাঠক। আবার আরও এক ধরণের কবিতা আমরা দেখতে পাই, যেখানে কল্পনা একেবারে গৌণ, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে লেখা  মাটির কবিতা। সুকান্ত-নজরুল-যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত এ জাতীয় বহু কবিতা আমাদের উপহার দিয়েছেন।আলোচ্য কবিতাটিও এই ধরণের :-


    পোড়া চোখে বৃষ্টি
-----------------------
কালো মেঘের বুকের দানাবাঁধা কষ্টগুলো
ব্যথায় টুকরো টুকরো হয়ে ঝরে পড়ে
পৃথিবীর বুকে রাগিনীর সুর তুলে,
মরা নদী খাল বিল ফিরে পায় হারানো যৌবন
সবুজ বন বনানী হয়ে ওঠে লাবন্যময়ী
ঝলসে যাওয়া রূপসী বাঙলা ফিরে পায় তার রূপ!


হে বৃষ্টি, তুমি সুন্দরী সুন্দরীতমা
আমার পোড়া চোখে অন্যরকম!


বাস্তুহারা মানুষের কাঁপন ধরা শরীর,
ছেঁড়া শাড়িতে বৃষ্টিভেজা জবুথবু
নারীর বিষণ্ণ ক্লান্ত মু্‌খ,
বৃষ্টিভেজা উদাম শিশুর ফ্যাকাশে কচিমু্‌খ,
খড়ের চালার কোণে গামছায় ঢাকা
মজুরের কাতর চাহনি
এই সব ভয়াবহ আরতি
বিদীর্ণ করে আমার হৃদয়!


বুকের ভিতর প্রজ্বলিত শিখা
নির্বাপিত হয় কী বৃষ্টির ছোঁয়ায়!
তবুও বৃষ্টিকে ভালোবাসি
এসো হে বৃষ্টি, এসো এ ধরায়!


শুধু এইটুকু মিনতি রেখ প্রিয়তমা বৃষ্টি,
নদীর দু’কূল ছেপে বান হয়ে এসো না!


       শিরোনামঃ- বৃষ্টিকে আমরা যে চোখে দেখতে অভ্যস্ত, কবির চোখে তা অন্য রূপে ধরা দেয়। সুতরাং কবিতাটির নামকরণ যথার্থ।


       ১ম স্তবকঃ- কবিতাটির মূল সুর প্রথম তিন পঙক্তিতেই স্পষ্ট করে দেন কবি। যদিও মেঘের বুকে কেন দানাবাঁধা কষ্ট, কেন ঝরে পড়া বৃষ্টির কণ্ঠে ব্যথাদীর্ণ রাগিনীর সুর, সেটি পরবর্তী তিন পঙক্তিতে একেবারেই বোঝার উপায় থাকে না। বরং পাঠক খানিকটা হকচকিয়ে যান। গ্রীষ্মের দাবদাহে শুকিয়ে যাওয়া(যৌবনহারা) খাল-বিল আর হতশ্রী বনানী তো যৌবন ফিরে পেলো। এ তো খুশির কথা। কবি এখানে পাঠককে খানিকটা দ্বিধায় ফেলে দেন।
        
     ২য় স্তবকঃ- এখানে দুই পঙক্তিতেই কবি পাঠকের দ্বিধা দূর করে দেন। সুন্দরী বৃষ্টিকে বলেন, তোমার রূপ "আমার পোড়া চোখে অন্যরকম!"


     ৩য় স্তবকঃ- এই স্তবকেই কবির মানব-দরদী অন্তঃকরণের পরিচয় পেয়ে যায় পাঠক।যে বৃষ্টি অগণ্য মানুষের জীবনে স্বস্তি এনে দেয় সে-ই বৃষ্টিই বাস্তুহারা পরিবারে অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়।ভারি চমৎকারভাবে পরিবারটির দুর্দশার কথা তুলে ধরেছেন কবি যা পাঠকের হৃদয়কে আর্দ্র করে তোলে।


     ৪র্থ স্তবকঃ- অমোঘ প্রশ্ন তুলেছেন এখানে কবি। শরীরের জ্বালা তো জুড়ায় বৃষ্টিধারা, কিন্তু বুকের জ্বালা? কবির ব্যক্তিগত জীবনে বৃষ্টি খুশির খবর নিয়ে এলেও বাস্তুহারা মানুষগুলির কথা ভেবে বুকে নিদারুণ জ্বালা অনুভব করেন, কবির এই অনুভবকে যখন পাঠক অনুভব করেন, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।


       ৫ম স্তবকঃ- আরও একবার আমরা কবির মানবিক মনের পরিচয় পাই, যখন তিনি বৃষ্টির কাছে প্রার্থনা করেন, তুমি এমনভাবে ঝরো যেন আমার দেশের অসহায় মানুষগুলো বানভাসি না হয়।
    
        উপসংহার:- এত কবিতা থাকতে এমন একটি সহজ-সরল কবিতা কেন বেছে নিলাম আলোচনার জন্য! আমার মনে হয়, কবিদেরও কিছু সামাজিক ভূমিকা থেকে যায়।আমরা তো বেশি কিছু করতে পারি না। কবিতা লিখেই না হয়  কিছুটা সামাজিক দায় পালন করি।এই কারণেই এই জাতীয় কবিতা আমার বড়ই প্রিয়।