যদিও ডিজিটালাইজেশন একটি বহুল চর্চিত বিষয় তবুও এর রূপ এবং মাত্রা দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে । তাই এ বিষয়টি নিয়ে সর্বমহলে ভাবনা ঠিকই থেকে যাচ্ছে। এই যুগে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ডিজিটালাইজেশন এর প্রতিরূপ বললেও ভুল হবে না! কোন বিষয়ই এখন নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলা সাহিত্যও নয়। প্রত্যেকটি  সাহিত্যের পটভূমি এবং পাঠক এখন প্রায় সারাবিশ্ব জুড়েই বিদ্যমান। তাই যেমন একটি সাহিত্যের ক্ষেত্র বেড়েছে, পরিধি বেড়েছে এবং এর পাঠক ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গাতেই তেমনই এর ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবনার আছে অনেক এই যুগে।


ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পরা সব বিষয়েরই ধনাত্মক এবং ঋনাত্মক প্রভাব লক্ষণীয়। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয় । তবুও এই প্রক্রিয়ার বাইরে থাকাও যুক্তিসঙ্গত নয়। সাধারনত আমরা একসময় অপসংস্কৃতির আগ্রাসন বলে এর এই বিষয়টি এড়িয়ে চলেছি যদিও এটি সুস্থ্য ও পরিশীলিত সংস্কৃতির প্রসারের মাধ্যমে প্রতিস্থাপনযোগ্য ছিলো! যার ফলে খুব স্বল্প পরিসরে বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়ন কার্যক্রম ঘটেছে, তবে তা যথেষ্ট  নয় বলা যেতে পারে। তাই বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়নকে আরো দ্রুত, বিস্তৃত এবং মান সম্মত উপায়ে সময়োপযোগী এবং বর্তমানের পরিবর্তিত রুচির পাঠকমহলের দৃষ্টি আকর্ষনে এর যথাযথ ডিজিটালাইজেশন করা জরুরী। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হবে? তা গবেষণা এবং চিন্তার বিষয়।


মানুষ এখন আগের যেকোন সময়ের চেয়ে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর। আমাদের ডিভাইস কেন্দ্রিকতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সঙ্গত কারণেই ব্যাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়নকে তড়ান্বিত করতে হলে এটিকেও তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ রূপান্তর করতে হবে। সহজভাবে বললে আমাদের বাংলা সাহিত্যকে আরও বেশি ডিজিটালাইজড করতে হবে। সহজলভ্য ডিভাইস ব্যবহার করে যাতে পাঠক সাহিত্যের স্বাদ নিতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ এটি করতে পারে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ,  ওয়েবম্যাগগুলো, ওয়েবজিনসমূহ, সাহিত্যের বিভিন্ন অ্যাপ এবং দ্বিভাষিক বা বহুভাষিক পত্রিকা ও অনলাইনসমূহ। কারন এসব মাধ্যমকে ব্যবহার করে দ্রুতই সারাবিশ্বের পাঠকদের কাছে সাহিত্যকর্ম ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। ডিজিটাল মাধ্যমসমূহে দেশের সীমানার বাধা নেই- এখানে যেকোন সাহিত্যকর্ম নিয়ে সবদেশই পৌঁছানো সম্ভব প্রযুক্তির মাধ্যমে, ভাষার বাধা নেই- কয়েক ভাষায় একই সাহিত্যকে উপস্থাপনের সুযোগ রয়েছে। এছাড়া অনুবাদের কঠিনতা এখন কম- এক্ষেত্রেও প্রযুক্তির সাহায্য নেয়া সম্ভব, নেই প্রকাশকালের বাধা- যেকোন সময়ই সৃষ্টিকর্মসমূহ প্রকাশ করা যায়, প্রকাশনা সামগ্রীর স্বল্পতা ইত্যাদি নেই। যেহেতু বিশ্বের যেকোন জায়গা থেকেই বৈশ্বিকভাবে বিষয়টি উপস্থাপন করা সম্ভব তাই এক্ষেত্রে এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত সেন্সরও কম! যদি আমরা প্রযুক্তিবিদদের ভবিষ্যতবানীসমূহ আমলে নিয়ে দেখা যায়- এই শতকের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে মানুষ সম্পূর্ণভাবে প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়বে। তারা তাদের প্রায় সব কার্যক্রম তাদের হাতে থাকা ডিভাইসের মাধ্যমে সম্পাদন করবে। বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ড. মিশিও কাকু তার "ফিজিক্স অব দি ফিউচার" বইয়ে বলেছেন, এই শতাব্দির- মধ্য শতকে, আমরা সম্ভাবত সবাই বাস্তব এবং ভার্চুয়াল জগতের মিশ্রণে বাস করব।" সাহিত্যকেও তাই ডিভাইস কেন্দ্রিক করতে হবে।বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে বাংলা সাহিত্যের ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া অংশগ্রহণ করতে হবে আরও বিস্তর পরিসরে। মোবাইল নির্ভর ভার্সনসমূহ এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবে- সাহিত্যকে পাঠকের পাঠ উপযোগী করতে মোবাইল ভার্সনে সকল পত্রিকাকে যেতে হবে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট, অ্যাপ বানাতে হবে এবং সাথে বাংলা সাহিত্যকে আরো বেশি ইংরেজিতে অনুবাদ করে উপাস্থাপন করতে হবে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে আমাদের সাহিত্যের বিশ্বায়ন তেমন হয়নি। এর কারনসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো- বাংলা সাহিত্যকর্মগুলো ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ খুবই কম হয়েছে এবং যা হয়েছে তার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।  (এখানে একটি ভবিষ্যত প্রযুক্তির উল্লেখ করা যেতে পারে তা হলো "সার্বজনীন অনুবাদক"। প্রযুক্তিটি যেকোন ভাষা থেকে অনুবাদ করতে পারবে যেকোন ভাষায়, তবে তা গুগল অনুবাদের চেয়ে উন্নত মানের হলেও কথা আছে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে সুন্দর অনুবাদ পেতে হলে ভাবানুবাদ এর সাথে সংগতিপূর্ণ বিশেষ সফটওয়্যার আমাদেরকে তৈরি করতে হবে যা বেশ কঠিন, অন্তত কৃতিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ডিভাইস না পাওয়া পর্যন্ত। তাই অনুবাদের কাজটি এখনও মেনুয়ালী করতে হবে!)। যাহোক একটি প্রিন্ট মিডিয়ার সীমাবদ্ধতা ছিলো এগুলো শুধুই বাংলা অথবা ইংরেজি যেকোন একটি ভাষায় প্রকাশিত হতো কিন্তু এখন অনলাইন হবার সুযোগে উভয় ভাষায় প্রকাশ সম্ভব। দৈনিক প্রিন্ট মিডিয়াগুলো সহ, ওয়েবম্যাগ,  ওয়েবজিন এবং অ্যাপসমূহের এখন এই কাজটি করার সুযোগ রয়েছে। কারন এগুলো চাইলেই দ্বিভাষিক বা বহুভাষিক হতে পারে। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এই অনুবাদ প্রক্রিয়ায় বৈশ্বিক বিবেচনায় পিছিয়ে থাকার কারনে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের ভালো ভালো কবি, সাহিত্যিক, সাহিত্যকর্ম থাকার পরেও আমরা বিশ্ব সাহিত্যে শক্তিশালী অবস্থান অর্জন করতে পারিনি।)


সুতরাং, যেহেতু আগামীদিনের পৃথিবী হবে আরও প্রযুক্তি নির্ভর, বহুভাষায় সমৃদ্ধ ডিভাইস থাকবে মানুষের হাতে, মিডিয়া হবে অনেকটাই পেপারলেস- তাই বাংলা সাহিত্যের বিশ্বায়নের লক্ষ্যে মুল ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া। সেই কর্মযজ্ঞ পালনের মত সক্ষমতাও অর্জন করতে হবে আমাদের । যেহেতু আগামী বিশ্বে বিশাল এক প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে সব দেশের সব সাহিত্যকে- কারন প্রযুক্তির কল্যাণে সব পাঠকই সব ভাষার সব সাহিত্য পড়তে পারবে। তারা উন্নত এবং সহজ প্রযুক্তির মাধ্যমে যে সাহিত্যকে হাতের নাগালে পাবে তার স্বাদই তারা নিবে।  সে সময়ের জন্য - বাংলা সাহিত্য কতোটুকু প্রস্তুত ভাবতে হবে লেখক-পাঠকসহ বোদ্ধামহল এবং প্রযুক্তিবিদদেরও ।
-------
প্রবন্ধটি দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত।