তানকা, হাইকু ও সেনরু
শংকর ব্রহ্ম


                     ধীরে ধীরে আমরা সংক্ষিপ্ত কবিতার দিকে এগোচ্ছি, কেননা মানুষ এখন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে থাকে, বড় ধরণের কাব্য রচনা করার বা পড়ার সুযোগ ফলে খুব কম, তাই দোঁহা, হাইকু, রুবাইত, লতিফা, চৌপদী, পঞ্চপদী, ষষ্ঠপদী, লিমেরিক ও তানকার প্রতি আগ্রহ আজকাল দেখা বেশী যাচ্ছে।


'তানকা' হলো জাপানি সংক্ষিপ্ত কবিতা।


(তানকা কি?
ঠিক যেন উত্তেজনাপূর্ণ, টি- টুয়েন্টি ম্যাচের মতো।)  


                       জাপানিরা  মনের ভাব সংক্ষেপে প্রকাশ করতেই বেশী পছন্দ করে। 'কথা কম কাজ বেশী',। এই নীতিতেই তারা বিশ্বাসী। মানে অল্প কথায় ভাবের ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে চায় তারা তাদের গীতি-কাব্যে। তাই জাপানকে বলা হয় 'হ্রষতম কবিতার দেশ।'


                         তানকার ফর্মটি (৫-৭-৫-৭-৭) মূলত ওয়াকা(waka) ফর্ম থেকে এসেছে৷ জাপানিরা গীতি-কাব্য হিসাবে তানকার ব্যবহার করতো, সেই অনুযায়ী ধ্বনিবিন্যাসই শ্রেয়।


                        জীবনের সুখ দু:খ, আশা-আকাঙ্খা, হতাশা,  প্রতিবাদ, আনন্দ, উল্লাস, নৈতিক অবক্ষয়, সবগুলিই অনায়াসে তানকার বিষয় হতে পারে।
                       তানকায় (৫-৭-৫) -কে জাপিনিরা upper phrase (কামি নো কু)-য়ে বিষয়বস্তু। এবং (৭-৭) -কে বলে lower phrase (শিমো নো কু)-য়ে সারমর্ম।


                          প্রথম তিন লাইনে বা চরণে প্রকাশ পায়  বিষয়বস্তু, ভাবমূর্তি, রূপ-কল্প, প্রতিরূপ, প্রতিচ্ছায়া-প্রতিচ্ছবি বা কথামালা এবং পরের দুই লাইনে প্রকাশ পায় সারমর্ম। তানকা বিষয়ের দিক থেকে জোর দেয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঋতুবৈচিত্র, জীবনের আশা নিরাশা প্রভৃতিকে।  


তিন প্রজন্মের তানকার তিনটি উদাহরণ -


১).


ক্লান্তি বিহীন
গাও হে কোকিল।
এক বছরে
দুবার কখনো কি
বসন্ত আসে বলো?
(ফুজিয়ানা নো ওকিকাজে - ৯১০ সাল)


২).


বিবর্ণ ফুল
আনমন হৃদয়ে
জগৎ দেখে,
সুবিশাল আকাশে
বসন্ত আসে ছুটে।
(রাজকুমারী শিকুশি - ১২০১ সাল)


৩).


এপ্রিল দূরে
মে মাসে বৃক্ষশাখা
ফুল শয্যায়
দিশাহারা নয়নে
অপেক্ষায় থাকে যে।
( মায়েদা য়ুউগুরে - ১৯৫১ সাল)


                    জাপানিরা গীতি-কাব্য হিসাবে ধ্বনিবিন্যাসে
তানকা লিখেছেন ঠিকই, তবে বর্ণবিন্যাসেও আজকাল তানকা ও হাইকু লেখা হচ্ছে বাংলা ভাষায়। আমরা যেহেতু তানকা বা হাইকুকে গীতি-কাব্য হিসেবে ব্যবহার করি না, সেই কারণে বর্ণবিন্যাসে লেখা হাইকু বা তানকা বাংলায় স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।


হাইকু কি?


                        হাইকু (একবচনে "হাইকি") একধরনের সংক্ষিপ্ত জাপানি কবিতা। তিনটি পংক্তিতে যথাক্রমে ৫, ৭ এবং ৫ জাপানি শ্বাসাঘাত মোরাস মিলে মোট ১৭ মোরাসের সংক্ষিপ্ত পরিসরে একটি মুহূর্তে ঘটিত মনের ভাব প্রকাশ করা হয়। জাপানি হাইকু তিনটি বাক্যে লিখিত হয়। সেই বাক্যটিতে ১৭টি মোরাস থাকে। সাধারণত একটি ছবি বর্ণনা করার জন্য হাইকু লিখিত হয়। মোরাস ও মাত্রা একই ব্যাপার নয়। ইউরোপিয়গণ ১৭ মোরাসকে ১৭ দল মনে করে হাইকু লেখার সূত্রপাত করেন। তাদের দেখাদেখি বাংলা ভাষায় ১৭ মাত্রার হাইকু লেখার প্রচলন হয়। মোরাস, দল ও মাত্রা এক-একটি ভাষার নিজস্ব শ্বাস অনুসারী। সেই অনুযায়ী ১২ মোরাসে ১৭ সিলেবল হয়। ইউরোপে ইমেজিস্ট আন্দোলনের পর ১৭ সিলেবলের পরিবর্তে আরো বেশি সিলেবলের হাইকু লেখা শুরু হয়েছে। জ্যাক কেরুয়াক প্রমুখ মার্কিন কবিগণ স্বীকার করেছেন যে মার্কিন উচ্চারণ জাপানি উচ্চারণ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক। তারা ১৭ দল ও তিনটি বাক্য-বন্ধন অস্বীকার করে হাইকু লিখেছেন।
                                হাইকু (Haiku) হল ওয়াকা ফর্মের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফর্ম।
                                 হাইকুতে (৫-৭-৫) সতেরোটি ধ্বনি আর তানকাতে ( ৫-৭-৫-৭-৭) একত্রিশটি ধ্বনি (সিলেবল) থাকে। এগুলি জাপানিদের আবেগপূর্ণ গীতি-কাব্য ।


তিন প্রজন্মের হাইকুর তিনটি উদাহরণ -


১).


মাঝ রাত্তির
সমুদ্রে জলরাশি
উত্তাল হলো।
(রানসেৎসু - ১৬৫৩ সাল)


২).


পাখা ওয়ালা
এক বোবা হাওয়া
অসহ্য তাপ।
(কাকো-১৭০০ সাল)


৩).


সহসা সূর্য
অচেনা ফুলদলে
কবিতা লেখে।
(বাশো - ১৮৯৪ সাল)


                            জাপানিরা 'সেনরু' নামে এক পংক্তির বহু কবিতা লিখেছেন। সেগুলি জনসমাজে খুবই জনপ্রিয়। মানুষের মুখে মুখে ঘোরে সে-সব পংক্তিগুলি, আমাদের বাংলার প্রবাদের মতো। তবে এইসব লেখার বেশীর ভাগ লেখকরই পরিচয় জানা যায় নি, আমাদের প্রবাদ বাক্যের মতো।


                           এখানে জাপানি পাঁচটি সেনরু-র উদাহরণ দিলাম।


১).


সোহাগ করলে মেয়েটার কথা বেড়ালের মতো হয়, না হলে মেঘ গর্জন।- অজ্ঞাত।


২).


বাজিয়ে জাগায় বাপ, বাঁশিটি সদ্য কেনা শিশুর জন্য। - শোকি।


৩).


দুজনে বেরোব, স্বামী কথা বলে আয়নার সাথে।
- সেইকো।


৪).


মেয়ে দেখতে এসে, মাকে পছন্দ হল শেষে।
-অজ্ঞাত।


৫).


স্ত্রী রাতেই থিয়েটারে যায়,স্বামীকে নেয় না সঙ্গে।
-  হাম্পনসেন।