কি এক দারুন অপেক্ষার আনন্দ নিয়ে -
আকাশকে বলেছিলাম তোর আসার কথা,
জেনেছিল সোনালি সকালটা, আর মেঘের পাড়ের রংধনুরা ।
রাতের আঁধারকে বলেছিলাম কানে কানে,
আড়ি পেতে শুনেছিল চাঁদ আর তারারা ।
বাতাসটা জানতেই খবরটা ছড়ালো চারিদিকে,
জানল প্রান্তরের বন, আর, দূর পাহাড়ের ঝর্ণারা,
জানাজানি হল ফুলেদের বুকে, পাখিদের কানাকানিতে ।


ওরা সবাই মিলে পংক্তির জোগান দিত আমায় ।
শব্দের বন্ধ্যাত্ব যখন আঁকড়ে ধরত, ছুটে যেতাম ওদের কাছে।
টের পেতাম ওদের গর্বিত ভাবটুকু,
শব্দ আর পংক্তি দিয়ে ওরা যেন ধন্য করছে আমায় ।
ওদের সাথে আমার প্রাণের যোগাযোগ ছিল বড় গাঢ়,
তোর আসার খুশীটা তাই বাঁটতে চেয়েছিলাম ওদের সাথে ।
ঠিক বুঝলাম, ওদের ঈর্ষা হচ্ছিল,
ওদের চাইতে তোকে না বেশি ভালবেসে ফেলি আমি ।
সংশয়ে ছিল ওরা, তোকে পেয়ে ওদের কথা না ভুলে যাই।
মনে মনে হেসেছিলাম ওদের কান্ড দেখে সেদিন,
শুধু ভেবেছি, কেমন হবে তোর সাথে ওদের প্রথম পরিচয়ের দিনটা ।                                                                                                                                              


তোকে প্রথম যেদিন কোলে পেলাম,
পুরো ব্রহ্মান্ডটাই যেন ধরা দিয়েছিল আমার দু’হাতের মাঝে,
তোর চোখে চোখ রাখতেই মনে হল যেন,
কৃষ্ণ-গহ্বরের দুর্দান্ত সম্মোহনীশক্তির ফাঁদে আমি আটকা পড়েছি ।
অসম্ভবরকম একটা গর্ব ভরিয়ে দিল ভেতরটা,
ইচ্ছে হল, তখনই ছুটে যাই তোকে নিয়ে ,
ওদের সবাইকে গিয়ে বলি, তুই এসেছিস ।
                                                                                                                                                                                                                                                                                                  
মনে পড়ে সেই প্রথম সকালের কথা,
যেদিন হাত ধরে বেরিয়েছিলাম তুই আর আমি ।
তোর চুলে দোলা দিয়ে গন্ধ নিয়েছিল বাতাস,
সে বাতাসে রন্ধ্র ভরেছিল বনানীর শাল-তমালেরা ।
তোর তুলতুলে গালে চুমু খেতে অস্থির হয়েছিল সকালের রোদ,
যে কিনা প্রতিদিন উষ্ণতার আদর দিত ফুলের পাপড়িতে।
ফুলেদের খানিকটা মন ভার হয়েছিল বটে,
তোর নরম হাতের ছোঁয়ায় মূহুর্তেই সেই রাগ গেল ঝরে,
তোকে নিয়ে পড়ল কাড়াকাড়ি,
কেউবা চাইল তোর ঠোঁটের গোলাপী, কেউবা আবার দুধ-আলতা গায়ের রং।
যে রাতে পূর্ণিমার প্লাবন দেখতে গিয়েছিলাম তোকে নিয়ে,
সেদিন তোর হাসি দেখে লজ্জায় মুখ গুঁজেছিল চাঁদ,
তোর কপালে রূপোর টিপ হবার লোভ সামলাতে পারলনা কিছুতেই,
বারবার উঁকি দিয়ে চেয়েছিল মেঘের আড়াল থেকে।
উন্মুখ হয়ে ছিল যোজন দূরের তারার দল, তোর সাথে খেলবে বলে,
ডেকেছিল তোকে হাতছানি দিয়ে ওদের সপ্তর্ষির মেলায় ।
কাকলি মুখর পাখিদের দল, তোর গানের সুরে হয়ে ছিল বিভোর,
মিলিয়েছিল গলা তোর সাথে, তুলেছিল ঐকতান সায়ন্তনের রাগে ।
কি নিবিড় মমতায় সবাইকে টেনে নিলি বুকে,
নির্বাক বিস্ময়ে শুনেছিল দশদিক,
তোর প্রাণের গান,আর ছন্দ-রঙীন তালে গাঁথা প্রথম কবিতার কথা –


“মেঘের খোঁপায় চাঁদের ফুল,
ঝুমকো তারার কানের দুল ।
বাসন্তী রং চাদর গা’য়,
ঝরা পাতার নূপুর পায় ।
ঝর্ণা রঙের ওড়নাখানি,
সাজল পরে সন্ধ্যা রানী ।
হাজার কথার অলংকার,
এই তো কবির অহঙ্কার । “