প্রতিদিন পতঙ্গদের বেড়ে ওঠা দেখি জানালার কার্নিশে,
নিবিড় হয়ে দেখি তাদের খোলস পাল্টানোর কষ্ট,
কি কঠিন শ্রমে তারা ভাঙ্গে দেহের  সুদৃঢ় আবরণ,
অতটুকু শরীরে এ যেন এক জীবন বাজি রাখা লড়াই।
কেউ বা হোঁচট খায় মাঝপথে- হয়না ভাঙ্গা পুরো খোলসের দেয়াল,
আধা-খোলসের দেহ নিয়ে চলে তারা খুঁড়িয়ে,
তারপর মুখ থুবড়ে পড়ে কিছুদূর এগিয়ে।
আপ্রাণ চেষ্টায় সফল হয় গুটি কতক,
যেন দুর্দান্ত একেকজন সৈনিক তারা।
তুলতুলে নরম শরীরে কেউবা চলে হেলেদুলে ,
পুরাতন খোলসের জঞ্জাল পেছনে ফেলে,
কি এক অসম্ভব কৃতকার্যতা তাদের গর্বিত চলনে।
কারোর শরীরে আবার নতুন ঝলমলে পাখা,
দারুণ দাপটে নিমেষেই ছাড়ে জন্মস্থান কার্নিশ,
মুক্তির আনন্দে মেলে ডানা অবারিত আকাশের বুকে।


আমিও এক রক্ত-মাংসের কীট,
রয়েছি আবদ্ধ হাজারো খোলসের বেষ্টনে।
সদম্ভে কাটে আমার ’সবজান্তা’র দিনমান
ভ্রূক্ষেপ নেই দূরে, যেখানে
জ্ঞানহীনতার বেড়া সীমায়িত করে অর্বাচীনের গন্ডি।
ধমনী জুড়ে জাগে জেতার অমোঘ নেশা,
আক্রোশের কুটিল জাল আটকায় চারপাশ,
করে দিকবিদিক জ্ঞানহারা।
স্বার্থপরতার চাদর ঢাকে হৃদয়ের হাতছানি,
বুঝে নিই সুচতুরভাবে নিজের ভোগের অংশটুকু,
নিই আত্মতৃপ্তির স্বাদ, মেকী গৌরবের কেদারায় বসে ।


সগর্বে তাকাই খোলসের দেয়ালে দেয়ালে,
হঠাৎ চোখে পড়ে তাতে ক’টা ফুটো।
ফুটো গলে কোন কোন দিন ঢুকে পড়ে আলোর রেখারা,
সুতীক্ষ্ন রশ্মিরা দেয় খোঁচা খোলসের আঁধারে।
অসহ্য এক ঝাঁকুনি জানান দিয়ে চলে নড়বড়ে খোলসের নশ্বরতা,
রুদ্ধ হয় শ্বাস প্রতিমুহূর্তে, নিঃশব্দ আর্তনাদ হৃৎপিণ্ড করে দীর্ণ,
খোলস ভাঙ্গার আকুতিতে করোটি জুড়ে চলে কি এক দুঃসহ যন্ত্রণা,
মনে হয়, আমি যেন সেই আধা-খোলসের কীট।


মুখ থুবড়ে পড়তে গিয়ে ফিরে পাই সম্বিৎ।
ছুটে যাই জানালার ধারে,
পতঙ্গদের কাছে যাচি খোলস ভাঙ্গার কৌশল,
বেরুবার উপায় খুঁজে ফিরি সারাক্ষণ।
চোখ যায় কার্নিশে পড়ে থাকা নিথর মরদেহটার দিকে-
ওইতো দিন কয়েক আগের সেই ডানাওলা মথ,
কঠিন খোলসের আগল ভেঙ্গে,
সাড়া দিয়েছিল যে রোদের সোনালী হাতছানিতে,
বর্ণিল ডানা মেলে হারিয়েছিল আকাশের নীলে।
মুহূর্তেই নিজেকে মুড়ি প্রচন্ড এক ঈর্ষার খোলসে,
ক’টি মাত্র দিনের পতঙ্গ-জীবন তার,অথচ কি পরিপূর্ণভাবে বাঁচল সে!
মরেও যেন সে রয়েছে কেমন জীবন্ত হয়ে,
হাত-পা তুলে চিৎ হয়ে পড়ে থাকা দেহখানা,
যেন এক বিশাল ব্যাঙ্গভরা অট্টহাসি।
সে যেন শিখিয়ে গেল, কি করে নিতে হয় মুক্তির স্বাদ,
দূরে ঠেলে ফেলে যত ঘৃণা, যত স্বার্থ আর অহঙ্কারের আবর্জনা,
প্রতিদিন যারা জমে জীবনের পরতে পরতে।
পতঙ্গের দেয়া মন্ত্র-বলে,
প্রাণপণে ভেঙ্গে চলি খোলসের দেয়াল, মুক্তির আহবানে।