আমরা আছি শহরের এখানে-সেখানে,
অলি-গলির আনাচে-কানাচে, দালান-কোঠার সুকঠিন গায়ে ।
আছি বিপণন ভবনের দেয়ালের কোণে,
ছড়িয়ে আছি পার্কে-টার্মিনালে, তোমাদের সকলের চোখ এড়িয়ে ।
রয়েছি অতন্দ্র প্রহরীর মত জেগে সারারাত, সারাদিন,
অবিরাম দুলিয়ে ঘাড় ডাইনে ও বাঁয়ে,
দেখে চলেছি তোমাদের গতিবিধি , সারাটিক্ষণ পলকহীন,
ক্লান্তি নেই তবু আমাদের এই ছোট ছোট কায়ে।
                                                                        
ল্যাম্পপোষ্টের পাশের আমি ঠায় দাঁড়িয়ে গলির বাঁকে,
প্রতিদিনকার মত ব্যস্ত আছি অন্বেষণে,
ঠিক কোন এক ফাঁকে,
চুরি গেল ওই মোড়ের দোকানে,
শুরু হোলো শোরগোল, ভিড় করল যত লোকে ।
বস্তির কিশোর ছেলেটি খেল বেধড়ক মার,
যান্ত্রিক চোখে রইলাম খানিকটা তাকিয়ে,
স্মৃতিতে রাখলাম ধরে কিছুটা তার,
যতটুকু পেরেছি দেখতে দূর থেকে গলা বাড়িয়ে।
চারপাশ ঘিরে চলেছে সমানে সমস্বরে খিস্তি,
আমার দূরত্ব থেকে বোঝা গেলনা ঠিক,
কে দিল ক’টা কিল, আর কে দিল ক’টা লাথি,
শুধু বুঝলাম, বেচারা ছেলেটির অবস্থা বড় বেগতিক ।
খানিক বাদেই থামল তার ব্যর্থ প্রতিরোধ,
নিস্তেজ হোলো সরু কাঠির মত দেহখানা তার,
দূর থেকে শুধু রইলাম আমি চেয়ে, যেন এক নির্বোধ,
ভাবলেশহীন যান্ত্রিক দর্শক, কেবলই নির্বিকার।
তদন্ত গোছের কিছু একটা বোধ হয় হোলো,
দারোগা এসে দেখল সব ঘেঁটে, খুলে আমার স্মৃতির যত খোলস,
তারপর জানা নেই, জল কোনদিকে কতদূর গড়ালো,
আমি আবার মন দিলাম, ভরতে আমার স্মৃতির ঝুলি- নির্ভুল, নিরলস।
                                                                                          
হাজারো এমনি স্মৃতি চলেছি আমি ধরে, সারি সারি বিদ্যুৎ কোষে,
আমার এই দেখে যাবার হয়তো হবেনা অবসান,
সহসা আগামি দিনে, কিংবা তারও বহু পরের কোনো মাসে,
যতদিন আছে আমার এই চোখে তড়িতের যোগান ।
নেহায়েতই অকাজে,
মরল সেদিন বস্তির ছোকড়াটা,
কোনো একদিন তারও আগে, মান খোয়ানোর লাজে,
ল্যাম্পপোষ্টের তারে প্রাণ দিল পাশের বাড়ির মেয়েটা ।
গলির কিছুটা ভেতরে,আমারই চোখের সামনে,
এইতো সেদিন খুন হোলো মাস্টার,
পাড়ার বখাটেদের হাতে, অহেতুক অকারণে,
ভাবখানা যেন, কি এসে গেল তাতে কার ।
                                                              
রক্ত-মাংসহীন যন্ত্র আমি। তাতে কি ?
চারপাশের এই স্মৃতির বোঝায় বড় দুঃসহ লাগে মাঝে মাঝে ।
বললে কেউ বিশ্বাস করবে কি?
ঘেন্না ধরেছে আজ, এই ’শুধু নজরদাড়ি’র কাজে।
আমার ধাতব শিরায় বয়ে চলে যত তড়িতের কণা,
খানিকটা তুলে নিয়ে তার,
পারতাম যদি ঘটাতে কোনো ভয়ানক দুর্ঘটনা,
যেমন করে বিদ্যুতপাতে হয় সব সংহার।
মূর্ছা যেত তাতে যত হায়েনার দল,
তোমাদের মাঝে যারা আছে লুকিয়ে, মানুষের মুখোশে,
এক-চোখা এই ক্ষুদে দানবের রোষানল,
হয়তো যেতনা দিতে কত অসহায় প্রাণ, এভাবে এত অনায়াসে ।
                                                                                              
তোমাদের মনে তোমরাই দেখ, দিয়ে নিজেদেরই চোখ,
একদিন হয়ত ভেতরে ভেতরে, কিছুটাতো হবে দহন,
শহর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা যত যন্ত্রের চোখ,
সেদিন হয়ত আমাদের আর হবেনা প্রয়োজন।