একবার প্রায় মরে গিয়ে সবে ঘরে ফিরেছি। কমপ্লিট বেড-রেস্ট চলছে । রাত জাগা বন্ধ , কড়া ডোজের ওষুধ খেয়ে বারোটা নাগাত ঘুমে আমি । আমার ঘুম মোটামুটি কম্পিউটারাইজড, শোবার সময় ব্রেনকে যা নির্দেশ দেই সে মোতাবেকই জেগে উঠি  । মনে পরে সেদিন সকাল সাতটা –আটটার দিকে ওঠার কথা ছিল ।বালিশের পাশে রাখা মোবাইলটা মাঝরাতে হঠাত ঘুম ভাঙ্গালো ।
দেখলাম রাত তিনটা বাজে – বোধহয় দেশের বাইরের ফোন হবে –
--‘হ্যালো’ বলতেই অন্যপাশ থেকে ব্রাশ ফায়ারের মতো ভাষণ শুরু হয়ে গেল—
‘ বাবা, এই দুনিয়া কিছু না , মানুষ শুধু ভুল করে , ইনসান আদমী শুধু নিজেদের ওপর জুলুম করে --- মানুষের পাপ নিয়ে লম্বা ফিরিস্তি—জ্বীনেরা অমুক করেছে তমুক করেছে –ইত্যাদি ব্যাপক একটানা ওয়াজ চলছে---
আমি এক ফাকে জিগ্যেস করলাম—
--“আপনি আসলে কাকে চাচ্ছেন?”
বাজখাই গলায় উত্তর এলো-
--“ মন দিয়ে কথা ক’খানা শুনো বাবা, আমরা মানুষ জাতির কেউ না , উর্ধ্বলোক থেকে এসেছি, তোমার সাথে আমাদের বিশেষ কাজ আছে ।“ আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম , তারপরও প্রশ্ন করলাম—
--“ তা , আমার নাম্বার আপনারা পেলেন কোথা থেকে?”
--“ আমরা ওপরে অনেকগুলা নাম্বার দিয়েছিলাম , উর্ধ্ব-আকাশে, সেখানে সব নাম্বার জ্বলে পুড়ে গেলো , শুধু তোমার নাম্বারটা বাবা ঠিক থাকলো , তুমি সেই বিশেষ মনোনীত ব্যাক্তি যে আমাদের বিশেষ কাজ করে দিবে ।“
সদ্য ঘুম ভাঙ্গা মানুষের ব্রেন চালু হতে সময় লাগে আর আমার মাথা আরো ট্র্যান্সে কড়া ওষুধের ডোজে ।“আপনার মেয়েছেলে কয়জন?” –এ জাতীয় বেয়াদপী মার্কা প্রশ্নের সাথে “ আপনার ছেলে-মেয়ে কয়জন জাতীয় স্বাভাবিক প্রশ্নও করে এরা আমার ঠিকুজি নিয়ে ফেললো ।
আমি উত্তর দিয়ে যাচ্ছি মনোযোগ দিয়ে, মাঝরাতে জ্বীনের রিমান্ড নাজিল হয়েছে , কি আর করা ? একবার মনে হলো, ওদের তো আমার এসব তথ্য জানারই কথা – আবার মনে হলো বোধহয় আমি সত্যি বলি কিনা তার  পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। ডিজিটাল জ্বীন সাহেবের মোবাইলে কথা বলাটার অস্বাভাবিকতা আমার মনে আসছেই না । অথবা হয়ত নন-স্টপ কথাবার্তার কারণে ভাবাভাবির সময়টাই আমি পাচ্ছি না ।
--‘আচ্ছা ,বাবা, আমাদের বাদশা ফারাজকে নিয়ে এসেছি, তোমার সাথে কথা বলবেন, ওনার সাথে তমিজ করে কথা বলবে । নাও বাবা, সালাম দাও।‘
আমি লম্বা করে টেনে টেনে বললাম , --‘আস সালামু আলাইকুম ওয়া রাহ্ মাতিহি ওয়া বারাকাতুহু ।‘
নতুন গলার স্বর এবার আরও ভারী –
_ ‘অলাইকুমাস......বাবা, মানুষ জাতির মধ্যে খুব অল্প লোক আছে যাদের সাথে আমি বিশেষ প্রয়োজনে কথা বলি, তুমি ভাগ্যবান।‘
--‘আমার কাজটা কি ,হুজুর?’
--‘তোমার জন্য আমাদের সাত খানা হাড়ী বোঝাই ধন-রত্ন আছে ,  তুমি নিজে ভোগ করবে, জ্বীন আর ইনসানদের মধ্যে কিছু বিলাবে ।‘
--‘সে তো আপনারা নিজেই পারেন , আমি কেন? ‘
--‘না, এই ধন রত্ন বিশেষ মানুষের মাধ্যমেই শুধু ব্যবহার করা যাবে ,উপরের বিধান, তোমাকে বেছে নেওয়া হয়েছে একাজের জন্যে ,বাবা।‘
লোকজন আমাকে বড় বড় ব্যাপারে বেশ বিশ্বাস করে , মনে মনে ফুলে গেলাম যাক এবার জ্বীন জাতিও আমাকে ম্যান্ডেট দিয়েছে ---
--‘আমি কি করব ,হুজুর?’
--‘আজ আর কথা নয় , সালাম দিয়ে ঘুমাতে যাও ,বাবা, কাল কথা হবে ।‘
আমার ঘুম গায়েব হয়ে গেছে আগেই, ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে মশারী ঠেলে বের হলাম, ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেছে ।
পরদিন আমি অপেক্ষায়, এবার ফোন এলো রাত ২টায় , একটু শরীর গতিকের আলাপ, সালাম পর্ব, বাদশা পর্ব , বাদশা গিন্নী পর্ব ,ইত্যাদি ম্যারাথন আলাপের পর বলা হলো কাল বিশদ বলা হবে।
তারপরদিন , জানানো  হলো মহাস্থান গড়ের মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশেষ একজনকে পাঁচটা গরু, ৩ মন চাল , ১মন দুধ ইত্যাদি পৌঁছে দিতে হবে। এতো ভারী জিনিষ বয়ে নিতে ঝামেলা বলে এর বদলে ক্যাশ দিলেও চলবে—ওনারাই সিন্নির ব্যাবস্থা করে নিবেন –তারপর লেনদেন রত্নে ঘড়ার।
আধাঘন্টা পরেই আমি ব্যস্ত হলাম- জয়পুরহাট , বগুড়া, নাটোর, রংপুর , রাজশাহী সব জায়গায় ফোন দিলাম –“ অমুক ,জায়গায় অমুক ব্যবস্থা কর।“
সবাই অবাক—‘বস কি পাগল হইসেন ? অসুখের ঘোর?”
আমি বললাম –
--“পাগল না আমি, আমি হলাম বলদ, আর এই বলদ সামনে রেখে মানুষখেকোটারে ধর।“
--“ ও বুঝছি গুরু , আপনারে ম্যাজিক দ্যাখায়া দিতাসি খারান, আপনি রেস্টে থেকেন ।“


আমি আসলে মনে মনে ইউ টার্ণ নিয়েছিলাম কোন এক রাতে, তবুও কথা চালিয়ে পিন পয়েন্ট করতে সময় লাগালাম।
রিপোর্ট এলো কয়েকদিন পর—
--“ ভাই, এরা মজিদের গ্যাং,--হাতে পায়ে ধরে মজিদ ভাগসে ,ভ্রু অর্ধেক কেটে দিসি, বাদ বাকী গুলান জেলে এখন ।“
এর মধ্যে খবর পেলাম মজিদও জেলে ঢুকে গেছে –বোধহয় অন্য কোথাও ধরা খেয়েছে।
সব শুনশান চার-পাচ মাস ।
হঠাতই এক রাতে আবার জ্বীনের বাদশার আগমন (এরা এতো ভুলো মনে কি করে ব্যবসা করে?)
নাকি নতুন গ্রুপ ? নাম্বার পেলো কোথায় ?
সেই লম্বা ভাষণ , তারপর নিয়ম মাফিক--
--“বাবা, সালাম ,দিয়ে বাদশার সাথে কথা বল...”
সেই সাত মোহর ভরা ঘড়ার কাহিনী  শেষে , এবার বললাম –
--“ আচ্ছা, এই সাত ঘড়ার বাজার মূল্য কত?”
--“সাত থেকে দশ কোটি টাকা তো হবেই বাবা ,কম করে হলেও ...”
--“শুনেন, আমার এর চেয়ে অনেক বেশীই আছে হুজুর, ঝামেলা করতে পারবোনা আর। আপনারা বরং অন্য কাউকে খুঁজে নেন যার লাগবে । এমনিতেই ট্যাক্স ,জাকাত নিয়ে বহুত ভ্যাজালে আছি।
ওপাশে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা ---
--“ তুমি কি বাবা ফাইজলামী কর আমাদের সাথে ?”
--“ অই , ফাইজলামী করতাসো তোমরা মজিদ গং, আবার ভুল জায়গায় এসে পরসো—এইবার শুধু ভ্রু না , পুরাই তোমাদের ছিইলা ফেলবো আমি এবার .........।। “
খটাস করে লাইন কেটে গেল। আমার একটু আফসোস হচ্ছে , খেলাটা আরেকটু জমানো যেতো...।।
এবার নতুন ফন্দি করে বসে আছি আমি। একজন সত্যিকারের  জ্বীন –হুজুর দিয়ে এবার লাঠি চালান পর্ব হবে – ফাইনাল খেলা—
অপেক্ষায় আছি আমি----
মাঝরাতে একটা বেনামী ফোনকল- ফ্যাস ফ্যাসে ভারী গলায় কেউ বলবে—
---“ বাবা, সালাম দিয়ে কথা বল......।।“
বাজখাই আরেক কন্ঠস্বর ......।।দীর্ঘ আলাপণ পর্ব...।।
তারপর অ্যাকশান >>>>>>>>