আলোচনা ৪৮


বউ-শ্বাশুড়ি  শিরোনাম দ্বারা এর ধরনের চিরাচরিত দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেলেও মুলত, পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যে নুতন নুতন সম্পর্কগুলো গড়ে উঠে এবং সে সম্পর্কের মধ্যে যে টানাপোড়ন তৈরি হয় তাই ফুটিয়ে উঠেছে এক কবিতায়। কবি  ফয়েজ উল্লাহ রবি (পারিজাত) তার ‘বউ-শ্বাশুড়ি’ কবিতায় মুলত, বিপরীতমুখী চাওয়াগুলোকে কেন্দ্র করেই বাস্তবতার নিরিখে সত্যচয়ন করেছেন।


আমারা সচরাচর নিজের জন্য যা চাই, অন্যের জন্য তা চাই না। নিজের জন্য যা ভাল মনে করি অন্যের ক্ষেত্রে ঠিক একইভাবে ভাবি না। পুরো কবিতার বিষয়বস্তু এরকম সরল সহজিকিকরন করে ভাবা যেতে পারে কিন্তু আমি একটু ভিন্ন ভাবে ভাবতে চাই। পুরো বিষয়টিকে পুরুষতান্ত্রিক তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখা করা যেতে পারে। একজন শ্বাশুড়ি যখন ছেলের মা তখন তিনি ক্ষমতাবান ফলে ছেলের বউয়ের সাথে যে আচরণ করেন, তিনি যখন মেয়ের মা তখন তার মেয়ের জামাই এর সাথে একই আচরণ করেন না। ছেলের মা যখন তখন শক্তিশালী কিন্তু যখন মেয়ের মা তখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল। ফলে একই ব্যাক্তি তার আচরণ পরিবর্তন করেন তার শক্তির উৎসকে কেন্দ্র করে। ফলে একজন শ্বাশুড়ি নিজের মেয়েকে অন্যের ঘরে রাজরানী হিসেবে দেখতে চান আবার অন্যের মেয়েকে নিজের ঘরে চাকরানী করে রাখতেই বেশী পছন্দ করেন।  কবি চমৎকার করে লিখেছেন-“পরের মেয়ে পরের ঘরে, আমার ঘরে চাকরাণী, আমার মেয়ে পরের ঘরে, থাকুক চাই, সে রাজরাণী।


একই ভাবে, কবি আরও কিছু উদাহরন দিয়েছেন,  “আমার মা-ই আমার আপন, শ্বাশুড়ি তো মা নয়!স্বামীর মাকে না ভাবলে মা, সম্পর্কের হয় যে ক্ষয়”। মুলত আমারা নিজের ক্ষেত্রে যা যা ভাবি বা চাই, অন্যের ক্ষেত্রে ঠিক তার উলটোটা চাই।


আবার অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিক মানুসিকতার  কারনেই, একজন মেয়ে অন্যের বাড়ীতে বউ হয়ে আসার পর তার প্রথম টার্গেট থাকে এ বাড়ির পুরুষের উপর তার পূর্ণমাত্রায় দখল বজায় রাখা। ফলে বউ এবং শ্বাশুড়ি এর মধ্যে তৈরি হয় টানাপোড়ন । ছেলের মা নিজের ছেলেকে আগলে রাখতে চান সারাক্ষন, ছেলেকে হারাবার ভয় তাকে পেয়ে বসে,
অন্যদিকে নুতন বউ তার স্বামীর উপর পূর্ণ মাত্রার‍ দখল রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেন । কবি সে কথাই বলেছেন ছন্দে ছন্দে,  “কষ্ট করে পাললাম ছেলে, এসে বৌ করলো পর, নিজের গড়া বাগানে আজ, মা-বাপের নাই যে ঘর”, “কুড়ি বছর করে লালন, দিলো তুলে হাতে, নিজের মেয়ে ভেবে তুমি, রেখো গো মা সাথে”।


এরকম আরও কিছু উদাহরন দিয়ে আমাদের চিরচেনা চরিত্র গুলোকে সাজিয়েছেন তার কাব্যে এবং কবিতার মূল বক্তব্য একটি তাত্ত্বিক কাঠামোর উপর দাড় করিয়েছেন। কবিতার পেছনে যখন কোন তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকে তখন সে কবিতা হয়ে উঠে জীবন দর্শন যা আমাকে খুব টানে। এ কবিতাটি আলোচনার জন্য বেছে নেয়ার মূল কারন ছিল তার তাত্ত্বিক ভিত্তি, অন্যথায় এটি খুবই সাধারণ বক্তব্য নির্ভর কবিতা হয়েই থাকতো। শুধুমাত্র তার তাত্ত্বিক কাঠামোর জন্য অসাধারন হয়ে উঠেছে অন্তত আমার কাছে। কবির জন্য রইলো একরাশ শুভেচ্ছা।