আলোচনা ৩০


চমৎকার এবং ভীষণ সময়োপযোগী একটি কনসেপ্ট নিয়ে কবিতাটি লেখা। লালন যেমন লিখেছিলেন, আমার ঘরে বাস করে ক’জনা, আমি জানি না কিংবা বাড়ির পাশে আরশিনগর...


একজন মানুষের মধ্যে অনেকগুলো মানুষ বসবাস করে, অনেকগুলো মূল্যবোধ একই সাথে কাজ করে, অনেকগুলো ভাবন এমনকি বিপরীতমুখী ভাবনাও একই সাথে কাজ করে। মানুষ এসব দ্বারাই চালিত হয়, প্রকাশ হয়ে পরে তার দ্বৈত চরিত্র, সব সময় মানুষ এর থেকে মুক্তি পায় না। কেউ কেউ খুব চেষ্টা করে অনেক উচু স্তরে উঠতে পারে কিন্তু সবাই পারে না ।


কবি অজিত কুমার কর এরকম একটি ইস্যু নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন ‘ প্রায়শ্চিত্ত’ যেখানে একজন ডাক্তারের দ্বৈত চরিত্র দেখিছেন।  তিনি যখন একজন ডাক্তার, তখন তিনি পেশাগত মূল্যবোধ দ্বারাই চালিত হন। ধর্ম-অধর্ম, জাত-পাত, ধনী-গরীব কোন কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তার কাছে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হল, রোগ এবং রোগী, রোগীকে সেবা দেয়াই তার একমাত্র কাজ- “গরীব দুঃখী বাদ পড়ে না, সুস্থ করাই যে তার কাজ, যেটুকু দেয় তুষ্ট তাতেই, চিত্তটি তার বেশ দরাজ”।


একজন ডাক্তার কখনওই সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে শ্রেণী বৈষম্য, ধর্ম বৈষম্য কিংবা জেন্ডার বৈষম্য করতে পারেন না, তার পেশাগত মূল্যবোধ তাকে অনুমোদন দেয় না । তাই কবি লিখেছে- “মুচি-বউয়ের কঠিন ব্যামো, সারল সেবায় ডাক্তারের, ডাক এসেছে দু'ক্রোশ দূরে, স্পর্শকাতর ব্রাহ্মণের”।  যে কোন শ্রেণী পেশার মানুষ যখন রোগী হিসেবে ডাক্তারের কাচে আসেন তখন তিনি স্পর্শকাতর হয়ে পরেন, মানবিকতাবোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে নিজের দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত হয়ে পড়েন, ভুলে যান নিজের অবস্থা ও অবস্থান, সেবা প্রদানই তার একমাত্র পরিচয়। তাই কবি আবার লিখেন-“কে অশুচি কে বা শুচি, বাছবিচারের বালাই নাই, অতি যত্নে চিকিৎসা তার, রোগ বলে 'পালাই পালাই”


পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে ডাক্তার যখন ফিরে যান তার নিজের পরিবেশে, নিজে পরিবারে, নিজের অবস্থানে, তখন সমাজ, সংস্কার, ধর্ম, জাত ইত্যাদি বিষয়গুলো আবার মুখ্য হয়ে পরে তার কাছে। সামাজিক আচার আচরণ দ্বারাই চালিত হতে থাকেন। ধর্মীয় এবং সামাজিক বাধা নিষেধ তার কাছে পেশা অপেক্ষা মুখ্য বিষয় হয়ে দাড়ায়। এ দ্বৈত অবস্থান সব মানুষকে আক্রান্ত করে না কিন্তু কবিতার আলোচ্য চরিত্র ডাক্তার বাবু ভীষণ ভাবে মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণায় ভুগেন। বলা যায় দ্বৈত চরিত্র দ্বারা তিনি আক্রান্ত হন। তাই তিনি প্রায়শ্চিত্ত করতে চান, সারাদিন নিম্ন জাতের সেবা করেছেন নিজের জাত ধর্ম ভুলে গিয়ে, নারী শরীর কিংবা হাত ধরেছেন চিকিৎসার প্রয়োজনে যা ধর্মীয় কিংবা সমাজ সংস্কারে গ্রহণযোগ্য নয়।  তাই কবি আবার বলেন-  “এ'হাত দিয়ে ধরেছিলাম, মুচি-বউয়ের একটা হাত, গঙ্গাজলে ধুইতে হবে, খুইয়ে দিলে নিজের জাত”।


অসাধারন একটি কনসেপ্ট নিয়ে লেখা কবিতা উপহার দেয়ার জন্য কবির জন্য রইলো অনেক শুভেচ্ছা।